রাজতন্ত্রে রাজার ফোনেও আড়ি পেতে সার্বক্ষণিক নজরদারি হতে পারে। আবার সেই রাজার প্রধানমন্ত্রীর ফোনেও একই কাজ করতে পারে তাঁর নিরাপত্তাবাহিনী। বিষয়টা যতই অবিশ্বাস্য শোনাক না কেন, মরক্কোর ক্ষেত্রে সেরকমটি ঘটে থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ‘নিষিদ্ধ কাহিনিগুলো‘ (ফরবিডেন স্টোরিজ) এর কাছে ফাঁস হওয়া অর্ধলাখ টেলিফোন নম্বরের তালিকা।এই তালিকা হচ্ছে ইসরায়েলের বহুল আলোচিত এনএসও গ্রুপের মোবাইল ফোনে আড়িপাতার প্রযুক্তি পেগাসাস এর গ্রাহকদের সম্ভাব্য লক্ষ্য যাঁরা, তাঁদের।তালিকাটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে ১০টি দেশের ১৭টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের প্রযুক্তিগত নিবিড় পরীক্ষার কাজটি করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাব। আর সেই পরীক্ষার ফল যাচাই করেছে কানাডার সিটিজেন ল্যাব।
তালিকায় শুধু মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীই নন, ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁখো, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সেরিল রামাফোসা, ইরাকের প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ অন্তত ১৪ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান রয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আধানোম গেব্রেইসুসের ফোনও এই তালিকায় রয়েছে।পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপরও নজরদারি করা হয়েছে। বিশ্বের অন্তত ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোনে এই পেগাসাসের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করা গেছে। মূলত কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সরকার আড়ি পাতার কাজে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে। ফোনে আড়িপাতা কেলেংকারি এটিই প্রথম নয়, এর আগে এডোয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য মিলেমিশে কীভাবে দেশে দেশে ফোনে আড়ি পেতে নজরদারি করছে।তা ছিল একান্তই সরকারি গুপ্তচরবৃত্তির অংশ। পেগাসাস এক্ষেত্রে একবারেই আলাদা। এটি বেসরকারি কোম্পানির ব্যবসা এবং তার কোনো জবাবদিহিতা নেই।
ফোনে নজরদারির এসব সাম্প্রতিক বিবরণ ফাঁস হয়ে যাওয়ার খবরে বিশ্ব জুড়ে যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তার পটভূমিতে এনএসও এক ব্যাখ্যায় দাবি করেছে অন্তত তিনজন - ফরাসী প্রেসিডেন্ট, মরক্কোর রাজা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক কখনোই এনএসও গ্রুপের গ্রাহকদের লক্ষ্য ছিলেন না এবং লক্ষ্য হননি। এই বিবৃতিতে ৫০ হাজার টেলিফোন নম্বরের তালিকার কথা যেমন অস্বীকার করা হয়নি; তেমনি অন্য যাঁদের নাম এসেছে তাঁরা যে লক্ষ্য ছিলেন সেকথাও নাকচ করা হয়নি। ফরাসী প্রেসিডেন্ট, মরক্কোর রাজা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনএসওর কোনো গ্রাহকের লক্ষ্য ছিলেন না বলে যে তাঁদের ফোন তালিকাবর্হিভূত হিসাবে নজরদারির আওতায় আসে নি, সেকথাও বিবৃতিতে প্রমাণ হয় না।
পেগাসাস নিয়ে অনুসন্ধানকারীরা বলছেন, ফরাসী প্রেসিডেন্টের টেলিফোনে আড়িপাতার স্পাইওয়্যারটি ঢুকিয়েছে মরক্কো।এনএসও দাবি করে, তারা শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে এই প্রযুক্তিগত ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর শর্তে পেগাসাস সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে থাকে। মরক্কোর কাছে হস্তান্তর করা পেগাসাসের লক্ষ্য যখন সেদেশেরই রাজা ও প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সাংবাদিকেরা তখন বোঝা যায় যে এই নজরদারির ক্ষমতা কতটা বিপজ্জনক। এতে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে যে এই ক্ষমতা প্রয়োগকারী নিরাপত্তাবাহিনী রাজা ও প্রধানমন্ত্রী, অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমনকি তারা দেশের বাইরের কোনো তৃতীয় শক্তির হয়ে যে কাজ করে নি, সেকথাও নিশ্চিত করে বলা প্রায় অসম্ভব। অনুসন্ধানকারীরা একইভাবে জানিয়েছেন যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোনে স্পাইওয়্যার ঢুকিয়েছে ভারত।ভারত তা অস্বীকার করে নি।উপমহাদেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব অনেক বিস্তৃত এবং ভারতের অন্য প্রতিবেশীরা যে এই খবরে উদ্বিগ্ন বোধ করবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
সিটিজেন ল্যাব এর আগে আল-জাজিরার ৩৬ জন এবং ভারতের কয়েকজন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর নজরদারিতে পেগাসাসের এই বেআইনী অপব্যববহারের তথ্য প্রকাশ করে। নিরাপদ যোগাযোগের জন্য নির্ভরযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হোয়াটসঅ্যাপের সুরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে ওইসব সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছিলো বলে অভিযোগ। হোয়াটসঅ্যাপ-এর স্বত্ত্বাধিকারী ফেসবুক এরপর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করে, যে মামলায় গতবছরের ডিসেম্বরে বিশ্বের চারটি শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি মাইক্রোসফট, গুগল, সিসকো এবং ডেল পক্ষভুক্ত হয়। এনএসও মামলাটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষভুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে আপত্তি জানালেও আদালত সেই আপত্তি নাকচ করে দিয়েছে।সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন, রিপোর্টাস স্য ফ্রঁতিয়েও এনএসওকে শিকারি ( প্রিডেটর) অভিহিত করে এই মামলায় সমর্থন দিয়েছে।
যে সব সংবাদপ্রতিষ্ঠানের যৌথ অনুসন্ধানে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসওর প্রযুক্তিপণ্য পেগাসাসের অপব্যবহারের বৈশ্বিক মাত্রার কথা উঠে এসেছে, তাদেরই অংশ ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ২১ জুলাই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইসরায়েল এনএসওর কার্যকলাপ তদন্ত করবে এবং এনএসওর সঙ্গে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সম্পর্কের ধরণাটা কী রকম। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রতিবেদন, ‘পেগাসাস প্রজেক্ট টার্নস স্পটলাইট অন স্পাইওয়্যার ফার্ম এনএসও‘স টাইজ টু ইসরায়েল স্টেট‘ বিশেষ তাৎপর্যবহ। ওই প্রতিবেদনে যে তথ্যগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো হচ্ছে : ১. ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুমোদন ছাড়া এনএসও কোনো প্রযুক্তি কোনো দেশ বা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে পারে না এবং কোন বিবেচনায় ওই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বিষয়; ২. কূটনৈতিক সর্ম্পক নেই, এমন দেশের কাছেও এটি বিক্রি করা হয়েছে; ৩. ব্যবসায়িক সর্ম্পক গড়ার মাধ্যমে কূটনৈতিক সর্ম্পক প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করে এধরণের রপ্তানি অনুমোদন দেওয়া হয়, যার দরুণ সৌদি আরব কয়েকবছর আগেই পেগাসাস হস্তগত করে; ৪. এধরণের অনুমোদনে ইসরায়েল সরকারের সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত, তার স্বীকৃতি মেলে ২০১৭ সালে হাঙ্গেরিতে তৎকালীন ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথায়। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে বাজারই ঠিক করে সবকিছু, আমি বাজারকে নির্দেশ দেই না … তবে একমাত্র যেখানে আমি হস্তক্ষেপ করি তা হচ্ছে সাইবারনিরাপত্তা; ৫. হাঙ্গেরি এবং ভারতে নেতানিয়াহুর সরকারি সফরের পরই পেগাসাস রপ্তানি হয়; ৬. এনএসও‘র উদ্যোক্তা পরিচালকরা বেশিরভাগই ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক সদস্য এবং আড়িপাতার মাধ্যমে সংগৃহীত সব তথ্যেই ইসরায়েলের অভিগম্যতা আছে বা জানার সুযোগ আছে বলে আমেরিকানরাও বিশ্বাস করে। এনএসও অবশ্য তা অস্বীকার করেছে।
এনএসও এবং পেগাসাসই ইসরায়েলের একমাত্র আড়ি পাতা প্রযুক্তিপণ্য নয়। এর আগে আল-জাজিরার অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে মোবাইল ফোনে আড়ি পাতার প্রযুক্তি বাংলাদেশও কিনেছে এবং তা হাঙ্গেরি থেকে কেনা হলেও মূলত ইসরায়েলের পিকসিক্স কোম্পানির প্রযুক্তিপণ্য।ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সর্ম্পক না থাকার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তখন জানানো হয়েছিল যে হাঙ্গেরি থেকে সেনাবাহিনী ওই প্রযুক্তিপণ্য কিনেছে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের প্রয়োজনে। তবে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা দপ্তর তাদের কাজে এধরণের কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশকে অনুমতি না দেওয়ার কথা জানিয়েছিল।এরপর গত মার্চে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এবং আল-জাজিরা ইসরায়েলি আদালতে দায়ের হওয়া এক মামলার নথি উদ্ধৃত করে জানায় যে পিকসিক্স এবং সেলব্রাইট বাংলাদেশে আড়িপাতা সরঞ্জাম বিক্রি করছে। ওই রপ্তানির অনুমোদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলাটি করা হয়েছিল। সেলব্রাইটের প্রযুক্তি গণতন্ত্রপন্থীদের দমনে ব্যবহৃত হবে যুক্তি দেখিয়ে হংকং ও বেলারুশে তা রপ্তানির বিরুদ্ধেও গতবছরের আগস্টে ইসরায়েলের আদালতে মামলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংগৃহীত আড়ি পাতার সরঞ্জাম অবশ্য একযোগে অনেক মোবাইলে নজরদারিতে সক্ষম, যার মধ্যে আবার বেছে বেছে নির্দিষ্ট ব্যাক্তির ফোনের তথ্যেও অনুপ্রবেশ করা যায়। আর পেগাসাস হচ্ছে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট ব্যাক্তির ওপর নজরদারির প্রযুক্তিগত গুপ্ত-হাতিয়ার, যাকে ওয়াশিংটন পোস্ট সামরিক মানের অস্ত্র হিসাবে অভিহিত করেছে।
পেগাসাসের সংক্রমণ বা গুপ্ত অনুপ্রবেশের লক্ষ্য যে ৫০ হাজার টেলিফোনের তালিকা ফাঁস হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো নাম এখনও উচ্চারিত হয় নি। তবে সিটিজেন ল্যাব ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যে ৪৫টি দেশে পেগাসাস পরিচালনার অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও ছিল (সূত্র: হাইড অ্যান্ড সিক: ট্র্যাকিং এনএসও গ্রুপ‘স পেগাসাস স্পাইওয়্যার টু অপারেশন্স ইন ৪৫ কান্ট্রিজ)। ফোনে আড়িপাতার মাধ্যমে ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার বেআইনীভাবে লংঘনের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে যে তোলপাড় চলছে, তার সবচেয়ে বেশি ঘটছে সম্ভবত ভারতে। কেননা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত দেশটিতে বিজেপির উত্থান এবং নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা সংহতকরণের পর কর্তৃত্ববাদের আর্বিভাব ঘটছে বলে দেশে-বিদেশে অভিযোগ উঠছে।২০১৯‘র জাতীয় নির্বাচন ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী এবং সাংবাদিকদের ফোনে আড়িপাতার তথ্যে তাই সবাই মোটামুটি নড়েচড়ে বসেছে।
বাংলাদেশে অবশ্য তেমন একটা প্রতিক্রিয়া না হওয়াই স্বাভাবিক। আড়ি পেতে ধারণ করা ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা গত এক দশকে যে পরিমাণে ঘটেছে, তাতে আর বিস্মিত হওয়ার অবকাশ থাকবে কী করে? সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিরোধীনেত্রীর ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়েছে বলে শোনা যায় নি।এরপর কত রাজনৈতিক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তার শুমার করা মুশকিল। সাংবাদিকেরাও যে বাদ যান নি, তারও সাম্প্রতিক প্রমাণ মিলেছে ব্যাক্তিগত পারিবারিক আলাপ ফাঁসে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বন্ধ করা। এমনকি পুলিশ নিজেরাও আড়িপাতা সংলাপ ফাঁসের শিকার হয়েছে। কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া আইনের শাসন যেহেতু অধরাই রয়ে যায়, সেহেতু ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সাংবিধানিক গ্যারান্টি লংঘনেরও কোনো প্রতিকার মেলেনি। প্রশ্ন হচ্ছে এই অপব্যবহারের আদৌ কি ইতি ঘটবে?
(২৪ জুলাই, ২০২১-‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন