এখন থেকে মাত্র দুই দশক আগেও খবরের জন্য আমরা প্রধানত: সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঘটনার খবর রেডিও–টিভিতে সবসময় পাওয়া যেত না। যদি পাওয়াও যেত, তাতে সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রধানত: থাকত মূল ঘটনা। কিন্তু খুঁটিনাটি বিবরণ, কিম্বা তার পটভূমি ও সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জানা ও বোঝার জন্য সংবাদপত্রই ছিল ভরসা। ২০০৪ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকের যাত্রা শুরু হলো। আমাদের অঞ্চলে তা জনপ্রিয় হতে আরও কয়েক বছর সময় কেটে গেছে। ২০০৫ এ আসলো আরেক বিস্ময় – ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউব। পরের বছর ২০০৬ এ এসেছে মাইক্রোব্লগিং নামের আরেক মাধ্যম টুইটার, যাতে মাত্র ১৪০ অক্ষরে খবর প্রচারের চল শুরু হয়। এরপর যোগ হয়েছে আরও আরও অনেকগুলো প্লাটফর্ম।
প্রথম প্রথম এসব মাধ্যমের বিষয়ে অনেকের মনেই কিছুটা সংশয় ও সন্দেহ ছিল। অনেকে জড়তাও অনুভব করতেন। কিন্তু গত এক থেকে দেড় দশকে এর প্রসার এতটাই ঘটেছে যে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে এখন রীতিমতো এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। লড়াইটা সহজ নয়। কেননা সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলো অনেককে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতায়িত করেছে। হাজার হাজার তো বটেই, এমনকি কোটি মানুষের কাছে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই নিজের কথা পৌঁছে দেওয়ার এ সুযোগ অনেকেই নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। রাজনীতিকেরা নিজেদের রাজনীতির প্রসারে, তারকারা তাদের তারকামূল্য বাড়াতে, পণ্যবিক্রতারা তাদের পণ্যের প্রচার ও বিক্রি বাড়াতে এসব মাধ্যমের দারুণভাবে লাভবান হচ্ছেন।
সামাজিক মাধ্যমের এই অভূতপূর্ব বিকাশ সমাজ ও অর্থনীতির প্রচলিত সব রীতিনীতি ও কাঠামোয় নানা রকম পরিবর্তন এনেছে। এসব পরিবর্তনের অনেকগুলো যেমন ইতিবাচক, তেমনি আবার কিছু আছে নেতিবাচক। আমরা সমাজে আগে যাদের প্রভাবশালী বলে জানতাম তাদের প্রভাবের উৎস ছিল অর্থনৈতিক বা রাজনৈদিক ক্ষমতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশিশক্তিরও ভূমিকা ছিল। কিন্তু এগুলোর সবই ছিল নির্দিষ্ট সীমানা বা এলাকার মধ্যে সীমিত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে প্রভাবশালীর পুন:সংজ্ঞায়ন হয়েছে। এখনকার অর্ন্তজালের জগতে প্রভাবশালীদের সীমানা নেই। পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে আরেকপ্রান্তের ঘটনাপ্রবাহে প্রভাবকের ভূমিকা নেওয়া এখন অসাধ্য কিছু নয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থাৎ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর তাঁর সহযোগী ও লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর যে রোষ ও ক্রোধের বহি:প্রকাশ ঘটেছে, তার পরিণতিতে যেসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সংবাদমাধ্যমে কী ধরনের অপপ্রচার হচ্ছে, তা আমরা সবাই জানি। ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগের দলীয় পরিচয়ের কারণে জনরোষের শিকার ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ করে চলেছে তারা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সুযাোগসন্ধানীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের উপর যে হামলা চালিয়েছে,, তা কেউ অস্বীকার করবে না। পুলিশী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় দুর্বৃত্তপনার এ সুযোগ তৈরি হয়েছিল, যার শিকার সংখ্যালঘু না হয়েও অনেকে হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হওয়ার খবরকে বহুগুণ ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে রাজনৈতিক অপপ্রচার চলছে।
এই অপপ্রচার এখন আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প এর আগেও একবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় একটি দলের নেতা হিসাবে তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই তিনি সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যাওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল তার পটভূমিতে ভিত্তিহীন অপপ্রচারের অভিযোগে ফেসবুক ও টুইটারে তিনি নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এরপর ক্ষুব্ধ ট্রাম্প নিজেই ট্রুথ সোশ্যাল নামে নিজস্ব একটি সামাজিক মাধ্যম চালু করেন। এবারের নির্বাচনের আগে ফেসবুক এবং এক্সও (সাবেক টুইটার) তাঁর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে সামাজিকমাধ্যমে তিনি এখন আগের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ’বাংলাদেশে হিন্দু, খৃষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর দলবদ্ধ হামলার’ নিন্দা জানিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও প্রসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের উপেক্ষা করার অভিযোগ করেছেন। আমিও এক্স ব্যবহার করি এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইটের প্রতিক্রিয়ায় আমি শুধু লিখেছিলাম, ’হিন্দু আমেরিকানদের ভোট বাড়াতে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার প্রসার’। ফল দাঁড়িয়েছে, শত শত উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদী গালাগালি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ক্রমশই বাছবিচারহীন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর এক অভূতপূর্ব মাধ্যমে রুপান্তরিত হতে চলেছে। ফেসবুকের মন্তব্য ঘিরে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও হাঙ্গামার ঘটনাও আমরা বেশ কয়েকবার প্রত্যক্ষ করেছি।
ইউটিউবও এখন আর পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ভিডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থা সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে এখন আমরা সবাই স্মার্টফোনে ভিডিও ধারণ করতে পারি। গত আন্দোলনে এই ভিডিওধারণের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা দারুণভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রযুক্তির এসব অগ্রগতির কারণে সাংবাদিকতা এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। যে কেউ যে কোনো জায়গা থেকে সেখানে ঘটে যাওয়া যে কোনো কিছুই ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দিতে পারে এবং মুহুর্তের মধ্যেই তা আলোড়ন তুলতে পারে। অনেকে বলেন, ’আমরা এখন ভাইরালের যুগে প্রবেশ করেছি’। কোনো কিছুর ব্যাপক প্রচার বোঝাতেই এই ভাইরাল বিশেষণটি ব্যবহৃত হয় এবং ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা এখন অনেকের নেশায় পরিণত হয়েছে। অনেকের আয়রোজগারের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভাইরাল ভিডিও, যার আরেক নাম কনটেন্ট। কনটেন্টের নেশায় অর্ধসত্য বা খন্ডিত তথ্য প্রচার কিম্বা তথ্য বিকৃতি ও ভিত্তিহীন বা বানোয়াট তথ্য প্রকাশ এখন নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে। এসব ভাইরাল কনটেন্টের সবচেয়ে বড় সমস্যা এগুলোতে কেউ সত্যতা যাচাই করে না, ঘটনা বা বক্তব্যের পটভূমি নেই বা অসম্পূর্ণ এবং তার ভ্রান্তিমূল্য ওই কন্টেন্টের নির্মাতা–প্রকাশক বিচার করেন না।
মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের খবর ও অন্যান্য রচনার সঙ্গে এসব সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের কনটেন্টের ফারাকটা এখানেই। সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক ও সম্পাদকেরা কোনো তথ্যই যাচাই–বাছাই ছাড়া প্রকাশ করেন না। ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঝুঁকি সেখানে সামান্যই। আবার মূলধারার গণমাধ্যমকে সবসময়েই বহুমত ও ভাষ্যকে স্থান দিতে হয়; তা কোনো একতরফা ভাষ্য প্রচারের মাধ্যম নয়। যদিও বিশ্বের বহু দেশেই রাজনৈতিক মতাদর্শনির্ভর সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল রয়েছে এবং শুধু নির্দিষ্ট মতধারার কারণে তা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ওঠে না। গণতন্ত্রে তা কখনোই কাম্য নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশ যেখানে তথ্য ও অপতথ্য, সত্য ও মিথ্যা, কানকথা ও গুজবের অহরহ মিশ্রণ ঘটছে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ সহজেই প্রসার পাচ্ছে, তার বিপরীতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বাসযোগ্যতার নিরিখে সংবাদপত্র এখন হয়ে উঠছে ভরসার কেন্দ্র, অনেকটাই পয়েন্ট অব রেফারেন্স। আশার কথা, আন্দোলনের দিনগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার যখন তথ্যপ্রবাহ রুদ্ধ করে দিতে ইন্টারনেটও বন্ধ করে দিয়েছিল তখন প্রথম আলোর মতো কয়েকটি সংবাদপত্র সেই ভূমিকা পালন করেছে। প্রমাণ করেছে, সাংবাদিকতা এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা কেন ফুরায়নি, ফুরাবে না।
(৪ নভেম্বর, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন