সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সংকটের সমাধান রাজনৈতিক পথেই

 সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সরকার পরিচালনায় নানাধরণের অসহযোগিতার মুখে কাজ করতে না পারায় হতাশবোধ থেকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস পদত্যাগ করতে চান। তিনি আরেকটি অর্ন্তবর্তী সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিদায় নিতে চান।


রাজনীতির পরিসরে গত কিছুদিন ধরে যে অস্থিরতা চলছিল, তাঁর এই কথিত পদত্যাগের সম্ভাবনায় তা আরও বহুগুণে ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু কোন পটভূমিতে এই পদত্যাগের গুঞ্জন?


লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের সময় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার জন্য কথিত করিডর প্রদানের প্রশ্ন, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর অসন্তোষ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে তখন এসব বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের কথিত কিছু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়।  


বুধবার ২১ মে সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যে সভা করেন, সেখানে নির্বাচন, করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, স্পষ্টত:ই তাতে সরকারের মতামতের প্রতিফলন ছিল না। 


সেনাপ্রধান ওই সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হওয়া বা মব সৃষ্টির বিরুদ্ধেও কথা বলেন। অথচ ২০ তারিখ রাতে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক হয়েছিল এবং তাতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। সেনাদরে অনুষ্ঠিত সভায় সেনাপ্রধানের বক্তব্য হিসাবে সংবামাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা যথার্থ ছিল না – এমন কোনো দাবি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে করা হয় নি। ফলে অর্ন্তবর্তী সরকার কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বলেই সরকারের সূত্রগুলো জানিয়েছে।  


সেনানিবাসে সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্বাভাবিক সময়ে সংবাদপত্রের পাতায় বড় শিরোনাম হওয়ার কথা নয়। সেনাশাসনের সময়ে অবশ্য এটি নিয়মিতই ঘটতো। কেননা, তখন সেনাশাসকের পক্ষে যে সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ আছে, সেটা প্রমাণ করা তাঁর জন্য জরুরি ছিল। 


ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যূত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে যে অর্ন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনার সাময়িক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, সেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতেও সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতি সবার বাড়তি আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি বর্তমানে গুজবের যে সুনামি চলছে, তার পটভূমিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।

 

২১ মে জেনারেল সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যখন সভা করেন, সেই একইদিনে সীমান্তের ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্তত ২৪টি ভুয়া তথ্য খন্ডন করেছে। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনুসকে ক্ষমতাচ্যূত করা, সেনাপ্রধানকে অপসারণ ও গ্রেপ্তার করার মতো ভুয়া তথ্য। স্পষ্টত:ই ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরা নানাভাবে দেশে যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে, এগুলো তারই অংশ। তবে দেশের ভেতরেও যে একাধিক গোষ্ঠী একইধরণের চেষ্টায় জড়িয়ে পড়েছে, এমন সন্দেহও প্রবল। 


এরকম স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনুসের পদত্যাগের গুঞ্জন এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্যের নানাধরণের ব্যাখ্যা তৈরি হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। 


কিছুদিন ধরেই দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজেদের মধ্যে এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে কিছু বিষয়ে অনাকাঙ্খিত বিতর্ক ও টানাপোড়েন চলছে। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রধান প্রধান শক্তির মধ্যেই অবিশ্বাস ও রেষারেষি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির কিছু নেতা দুজন ছাত্র উপদেষ্টা – মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ ভুঁইয়া সজীবের পদত্যাগ দাবি করেছেন। 


এর পাল্টা হিসাবে ছাত্রদের তৈরি নতুন দল এনসিপি অন্য তিনজন উপদেষ্টা – সালেহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিএনপির প্রতিনিধি অভিহিত করে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এ ধরনের বিরোধ যখন অর্ন্তবর্তী সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তখনই সেনাপ্রধানের এসব বক্তব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।


যে বিষয়টি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো, সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন। নির্বাচনকে সংস্কারের শর্তসাপেক্ষ করার বিষয়টি গণঅভ্যূত্থানের পর যতটা প্রবল ছিল, গত ৯ মাসে তা অনেকটাই মিইয়ে এসেছে। শাসনব্যবস্থার প্রায় সব জায়গায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনূভূত হলেও তা সম্পন্ন করা যে সময়সাপেক্ষ, সেকথা অনস্বীকার্য। কিন্তু ন্যূনতম সংস্কারের অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ায় ধৈর্যচ্যূতি ঘটাও তো স্বাভাবিক। একদিকে প্রতিশ্রুত সংস্কারের শ্লথগতি, অন্যদিকে শাসনকাজে দুর্বলতা বা ক্ষেত্রবিশেষে অক্ষমতাও প্রধান উপদেষ্টার হতাশার অন্যতম কারণ বলেই জানা যাচ্ছে।    


রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্যে মব সৃষ্টির কৌশলও অনুসৃত হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।  সরকারের নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ আদায়ের বেপরোয়া চেষ্টা পরিস্থিতিকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বিক্ষোভ–প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতিতে দৃষ্টিকটু অসঙ্গতিও সন্দেহ–সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। ছাত্রদের সংগঠিত নতুন দল এনসিপির কর্মসূচিতে পুলিশের নমনীয়তা যতটা দেখা গেছে, অন্যদের বেলায় তা ঘটে নি। 

 

দেশের ভেতরে ও বিদেশে অধ্যাপক ইউনুসের প্রতি সমর্থন ও আস্থার কোনো কমতি নেই। গভীর সংকটের সময়ে আন্দোলনের সব শরীকেরা নি:সংশয়ে তাঁকে অভিভাবকের আসনে আসীন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বগ্রহণের প্রায় দুই সপ্তাহ পর ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ’বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে।’ 


সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ’গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই- উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনও ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ 


দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র–জনতার ঐক্যে ভাঙ্গন ধরতে শুরু করলেও তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মনে হচ্ছে, তা আর ঠিক হওয়ার নয়। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হবে বিপর্যয়। পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরা ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানকে জঙ্গীদের উত্থান হিসাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে যে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি–শৃঙ্খলা যেমন গুরুতর রুপ নিতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও বিপজ্জনক ঝুঁকির মুখে পড়বে।


অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা কোথায় এমন প্রশ্নের মুখে কিছুদিন আগে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মুখে শোনা গেছে, ‘‘ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র।” পরে তিনি ফেসবুকে বিষয়টি আরও বিশদে তুলে ধরে বলেছেন, ”জোড়াতালি দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব না, সম্ভব নয় নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই৷ কিন্তু, ঠিকই প্রশাসন, বিচারবিভাগ, পুলিশে তারা স্টেইক নিয়ে বসে আছেন।”


প্রশাসন ও পুলিশে রাজনৈতিক দলগুলো স্টেক নিয়ে বসে থাকুক বা না থাকুক, রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে বলে তাদের বিশ্বাস, তারা ইতিমধ্যেই সেসব দলের আস্থা অর্জনে নেতা–নেত্রীদের তদবির রক্ষায় ব্যস্ত। সরকারের সংস্কার বাস্তবায়নে তাদের অধিকাংশেরই ন্যূনতম আন্তরিকতা নেই, আগ্রহও নেই। ব্যবসা–বাণিজ্যেও গতি আসছে না, কারণ বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা চান। অন্য কথায় তারাও নির্বাচনের অপেক্ষায় আছেন। সেনাবাহিনীও নির্বাচনের বিষয়ে একই অবস্থান নিয়েছে। 


ক্ষমতার অনেকগুলো ভরকেন্দ্রকে আস্থায় রাখা নি:সন্দেহে খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ । অর্ন্তবর্তী সরকার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে তা যথাযথভাবে সামাল দিতে পারেনি। তবে কোনো চ্যালেঞ্জই অজেয় নয়। দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনে সব রাজনৈতিক দলই অবদমনের শিকার হয়েছে। সুতরাং শৃঙ্খলমুক্তির পর তারা যে নিজেদের আশা–আকাঙ্খা পূরণে অধৈর্য হয়ে পড়বে, সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সেকারণেই রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রাখার প্রশ্নে অর্ন্তবর্তী সরকারের বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। 


গত ৯ মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে সম্ভবত মাত্র চারটি। তাঁদের যৌক্তিক প্রত্যাশা ছিল সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁরা তাদের মতামত দিতে পারবেন। এই  যোগাযোগটা আরও নিবিড় হলে বর্তমানের দৃশ্যমান অনৈক্য দেখতে হতো না। এটি কাটিয়ে ওঠার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কেননা, রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় গত সপ্তাহ পর্যন্ত এসব দল সক্রিয় অংশগ্রহণ চালিয়ে এসেছে এবং তা অব্যাহত রাখার কথা বলেছে।


স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রথম ভাষণেই বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই নির্বাচনের প্রশ্ন নিয়েই এখন সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ ও হতাশার উর্ধ্বে উঠে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হবেন এবং সব দলকে ডেকে আবারও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন বলেই দেশবাসী আশা করে। শান্তির জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে তাঁর সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।


(২৮ মে, ২০২৪ এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...