সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নির্বাচনী আচরণবিধিতে এআই নিয়ে কথা নেই কেন

 গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন ’সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০২৫’–এর খসড়া প্রকাশ করে আগামী ১০ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়ে নাগরিকদের মতামত আহ্বান করেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই আচরণবিধি, যা প্রতিযোগিতার মাঠকে সবার জন্য সমান করতে প্রয়োজন। 


আচরণবিধিতে খুব বেশি নতুনত্ব নেই, যদিও কিছু পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপের ওপর বাড়তি গুরুত্ব নজরে পড়ে। নির্বাচনী প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ব্যবহারের প্রসঙ্গ শেষমুহূর্তের সংযোজন না হলেও খুব সুচিন্তিত নয়। 


সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা, এই আচরণবিধিতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় নি। কিংবা কমিশনের তরফ থেকে কী ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার কোনো ধারণা মেলে না। 


অথচ বিশ্বের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে এআইয়ের অপব্যবহার বিপজ্জনক রুপ নিয়েছে। আচরণবিধির অন্যান্য বিষয়ে কিছু বলার আগে তাই এআইয়ের সম্ভাব্য অপব্যবহারের ঝুঁকির কথাই বলা দরকার।


২.

গত ২ জুন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার আর্ন্তজাতিক সংস্করণে ইতোমধ্যেই ৫০ টি দেশের নির্বাচনে এআই কী ধরণের হুমকি তৈরি করেছিল, তার উল্লেখ করে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। 


’এ আই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে’ (এ আই কনটেন্ট ইজ স্টার্টিং টু ওয়্যার ডাউন ডেমোক্র্যাসি) শিরোনামের এই প্রতিবেদনে তারা সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসাবে কানাডার নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিকে শিশু যৌননিপীড়ক জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে সুইমিং পুলে একসঙ্গে সাঁতার কাটার বানোয়াট ছবি এক্স (সাবেক টুইটার) প্লাটফর্মে ছড়িয়ে পড়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। 


মার্ক কার্নির বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার কাজে আসেনি। কিন্তু রুমানিয়ায় গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এআইয়ের অপব্যবহার ঘটেছিল দেশটির বাইরে রাশিয়ার একটি নেটওয়ার্ক থেকে এবং শেষ পর্যন্ত আদালত সেই নির্বাচন বাতিল করে দেন। 


এরপর দেশটিকে গত মার্চে নতুন করে নির্বাচন আয়োজন করতে হয় এবং আগের নির্বাচনের বিজয়ী আর প্রার্থী হতে পারেননি। এআইয়ের অপব্যবহারের কারণে নির্বাচন বাতিল হওয়ার ঘটনা বিশ্বে এটিই প্রথম হলেও শেষ যে নয়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। 


৩.

২০২৪ সাল ছিল বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের বছর। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ গতবছরে তাদের ভোটাধিকারচর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডের একটি স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন দ্য ইনফরমেশন এনভায়রনমেন্ট তাদের গবেষণার ভিত্তিতে বলেছে, এসব নির্বাচনের ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এআই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে তার সবটাই যে নেতিবাচক বা ক্ষতিকর, তা নয়। 


জরিপে তারা দেখেছে, ২৫ শতাংশ এআইয়ের ব্যবহার প্রার্থীরা স্বচ্ছ্বতার সঙ্গে করেছেন, মূলত বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের বক্তৃতা–বিবৃতি স্থানীয় ভাষা ও উচ্চারণরীতি অনুযায়ী ভাষান্তরের জন্য। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর অনিষ্ট করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাই হচ্ছে প্রধান প্রবণতা।


এআইকে হাতিয়ার হিসাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারে আমরাও যে পিছিয়ে নেই, তা স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা ইতোমধ্যেই চিহ্ণিত করে তুলে ধরেছেন। 


গত ৩০ জুন ডিসমিসল্যাব তাদের যে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে, তা খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। ১৮ থেকে ২৮ জুন, মাত্র ১০ দিনে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে ৭০টি ভিডিও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছে, এগুলো এআই দিয়ে তৈরি। 


এসব রাজনৈতিক প্রচারমূলক ভিডিও বিশ্লেষণে তারা দেখেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উল্লেখ করা হয়নি যে এগুলো এআই দিয়ে তৈরি। ভিডিওগুলো অনেকটা নিখুঁত। ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাবের কারণে এসব ভিডিওতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাই প্রবল। 


ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা ভিডিওগুলো ২ কোটি ৩০ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে (ভিউ)। ভিডিওগুলোতে ব্যবহারকারীরা রিঅ্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) দিয়েছেন ১০ লাখের বেশি। 


ডিসমিসল্যাব তাদের গবেষণায় বলছে, প্রতিটি ভিডিও গড়ে প্রায় ৩ লাখ ২৮ হাজারবার দেখা হয়েছে এবং গড়ে ১৭ হাজার রিঅ্যাকশন পেয়েছে, যা এসব আধেয়র (কনটেন্ট) বিস্তার ও প্রভাব সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। 


ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলন কেউই এ থেকে পিছিয়ে নেই। এআই ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এর জন্য বেশি জনশক্তির প্রয়োজন নেই, দরকার প্রযুক্তিজ্ঞানের অধিকারী কিছু সৃজনশীল কর্মী ও বিনিয়োগ। 


গোপনে বা প্রবাস থেকে কার্যক্রম পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগও এ কাজে পিছিয়ে নেই। ভবিষ্যতে যে তা আরও বাড়বে, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। কেননা, ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পরপর তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের একটি বড় অংশ পালিয়ে প্রতিবেশি ভারত এবং ইউরোপ–আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রচারণায় প্রযুক্তির ব্যবহারে ভারত, বিশেষ করে শাসকদল বিজেপি অনেকদিন ধরেই এগিয়ে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের তৎপরতা যে বহুগুণে বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়।  


৪.

গণতন্ত্রে নির্বাচন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্য যখন ভোটার সজ্ঞানে তাঁর পছন্দ বেছে নিতে পারেন। কিন্তু তাঁকে যদি বিভ্রান্ত করা যায়, তাহলে তা আর জেনেশুনে বাছাই হবে না, হবে গুরুতর ভুল। 


মনে হতে পারে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেখানে এআই এর বিপদ থেকে তাদের নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের আর কী করার আছে? উত্তর: আছে। আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে। ঝুঁকি পুরোপুরি দূর করা না গেলেও অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে। নির্বাচন কমিশনকে তাই এখনই এবিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। 


পোস্টার নিষিদ্ধ করা, ব্যানারের মাপ ঠিক করে দেওয়া কিম্বা এক রঙা প্রচারপত্রের বাধ্যবাধকতা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় সমতা ও ন্যয্যতার জন্য জরুরি ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি এআইয়ের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং প্রতিপক্ষকে যেনতেনভাবে ঘায়েল করার অপচর্চা ঠেকানো। 


আমরা আগের অন্তত: দুটি নির্বাচনে দেখেছি, অর্ন্তদলীয় কোন্দলেও প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ভুয়া আধেয় ছড়ানো হয়েছে। ভোটের আগের রাতে কন্ঠ নকল করা অডিও ছড়িয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ভুয়া  ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। এখন সেই বিপদ বহুগুণে বেড়েছে। 


মেটা, গুগল, মাইক্রোসফট, এক্সসহ প্রায় সব বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি ও প্লাটফর্ম নিত্যনতুন সুবিধাসহ গ্রাহকবান্ধব এআই টুলস সহজলভ্য করে চলেছে। ডিপফেক ভিডিও তৈরি এখন এতটাই সহজ হয়েছে, যে প্রার্থী এবং দলগুলোকেও এখন সারাক্ষণ আতঙ্কে কাটাতে হবে। 


৫.

এআই ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু অপব্যবহার রুখতেই হবে, অন্তত সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রার্থী বা দলের পক্ষে ইতিবাচক বা প্রতিপক্ষের জন্য নেতিবাচক প্রচারের লক্ষ্যে দেশের ভেতরে এবং বাইরে যে কেউ এআই ব্যবহার করলে, তার স্পষ্ট ঘোষণা সেই কন্টেন্টে থাকতে হবে, নাহলে প্রার্থী এবং দলকে তার জন্য দায় নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা দরকার।


প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, কুৎসা কিম্বা মানহানিকর কিছু করা হলে তা নির্বাচনী অপরাধ হিসাবে গণ্য করে তার  তাৎক্ষণিক সাজার বিধান রাখা প্রয়োজন। 


এসব অপরাধ চিহ্নিত করায় কমিশনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন এত অল্প সময়ে সম্ভব নাও হতে পারে, এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে কমিশনের উচিত হবে প্রযুক্তিখাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া। 


দেশে যাঁরা প্রযুক্তিখাতের ভালো–মন্দ নিয়ে কাজ করছে, তাঁদের একত্রিত করে একটি সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সে জন্য প্রবাসী প্রযুক্তিবিদদের সাময়িক সময়ের জন্য দেশে এনে অথবা দূরযোগাযোগের মাধ্যমে কাজে লাগানোর উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত। 


বড় প্রযুক্তি প্লাটফর্মগুলোর সহযোগিতাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য অর্ন্তবর্তী সরকারকে যেমন বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলা যায়, তেমনি কমিশন নিজেও উদ্যোগী হয়ে এসব কোম্পানির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। 


ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা, এক্স , মাইক্রোসফট, গুগল, ইউটিউব এদের সবারই অপতথ্য, ভুয়াতথ্য বা কুতথ্য প্রচার ঠেকানো বা অপসারণের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু তারা যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা প্রতিপালনে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে, সেটা আমরা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ করছি। 


কিন্তু উন্নত ও ধনী দেশগুলোর মতো তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কিংবা জরিমানার মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি প্রধানত: আমাদের দূর্বলতার কারণে। এখন তা কাটিয়ে উঠতে হবে। 


৬.

গত বছর ওপেন এআইয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে তারা রুয়ান্ডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা কীভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছে, তার ওপর আলোকপাত করেছে। 


গত বছরের মে মাসে ইসরায়েলি একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি ভারতের নির্বাচন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া মন্তব্য উৎপাদনের চেষ্টা করায় ওপেন এআই কীভাবে তা নস্যাৎ করে দিয়েছিল, সে কথাও তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে। জিরো –জিনো নামে ওপেন এআই ওই অপারেশন চালিয়েছিল। 


বহুজাতিক প্রযুক্তি প্লাটফর্মগুলোর কাছ থেকে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের জন্য সহযোগিতা আদায় করা তাই একেবারে দু:সাধ্য কিছু নয়। 


এআইএর অপব্যবহার যদি আমাদের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ধারকে বিভ্রান্তির গহ্বরে ঠেলে দিয়ে ভবিষ্যৎকে আরও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়, তাহলে তার দায় কিন্তু নির্বাচন কমিশনকেও বহন করতে হবে। 


৭.

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের বিষয়েও নীতিমালাটি অসম্পূর্ণ। মনে রাখা দরকার, সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের একটা বড় অংশ প্রবাসীদের পক্ষ থেকে হতে পারে , আবার বিদেশি রাষ্ট্র বা কোনো প্রতিষ্ঠানও করতে পারে। 


সুতরাং সেগুলো নিয়ন্ত্রণের উপায়ও উদ্ভাবনের কথা ভাবা দরকার। আর নির্বাচনী ব্যয়ের সবটাই ব্যাংকিং মাধ্যমে করা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে তা খুঁজে বের করা ও তার নিরীক্ষা সম্ভব হয়, না হলে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।    


(৭ জুলাই, ২০২৫–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)



 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...