সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চিকিৎসকের সাইকোলজিক্যাল চাপ!


ব্রিটেনে চোখের চিকিৎসায় সেরা হাসপাতাল মুরফিল্ডস। তবে, হাসপাতালের সুনাম থাকলেই যে সেরা চিক্রিসা মিলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঐ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় কথাটি আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। আমার অভিজ্ঞতা যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‍যে সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরছেন সেটা একটা ভালো খবর এবং স্বস্তির কথা।

প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে সরকারীভাবে কিছুই জানানো হয় নি। বরং, সফরের শুরুতে বলা হয়েছে এটা একটা সরকারী সফর। যুক্তরাজ্যে দশদিনের সরকারী সফর নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে কৌতুহল তৈরি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, তাতে সরকারের কিছু আসে-যায় বলে মনে হয় না।  তিনি যে লন্ডনে চোখের চিকিৎসা করিয়েছেন সেটা তাঁকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বাংলা ট্রিবিউন নামের একটি অনলাইন পোর্টাল। পত্রিকাগুলোর খবরে বিষয়টি উহ্য রাখা হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউন ৯ মে দেশের ডাক্তাররা সাইকোলজিক্যাল কারণে অপারেশনের ঝুঁকি নিতে রাজি হননি: প্রধানমন্ত্রীশিরোনামে লিখেছে নিজের চোখের অপারেশন দেশেই করতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, দেশের ডাক্তাররা সাইকোলজিক্যাল কারণে আমার চোখ অপারেশনের ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তাই বাধ্য হয়ে ব্রিটেনে এই চিকিৎসা নিতে হলো।সফরের শেষ প্রান্তে ৯ মে লন্ডনের তাজ হোটেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর এক মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে কালের কন্ঠের এক খবরে লন্ডনে তাঁর চিকিৎসার কথা বলা হলেও সরকারীভাবে কিছুই জানানো হয় নি।

প্রধানমন্ত্রীর বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। চিকিৎসকদের সাইকোলজিক্যাল দ্বিধার বিষয়টিকেই তাঁরা বিস্ময়ের কারণ হিসাবে দেখছেন। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের বিদেশে চিকিৎসাগ্রহণ মোটেও নতুন কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্রপতিও এর আগে লন্ডন ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে, তাঁকে চিকিৎসা সেবা দিতে চিকিৎসকদের কোনো সাইকোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছিল কিনা তা আমাদের জানা নেই। তিনি তা কখনও বলেন নি।

চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশমুখী হওয়ার প্রধান কারণ সাধারণত দেশে উপযুক্ত চিকিৎসার সুবিধা না থাকা অথবা দেশের চিকিৎসা কাঠামোয় আস্থাহীনতা। এরকম ক্ষেত্রে সাধ্যে কুলালে অনেকেই ভালো বা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। তবে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত এখন যে খুব পিছিয়ে আছে তা নয়। ফলে, অল্প কিছু রোগ ছাড়া সাধারণত অধিকাংশ রোগের চিকিৎসাই দেশের ভিতরে সম্ভব।   

তবে, দেশের ভিতরে উপযুক্ত চিকিৎসাকাঠামো থাকার পরও দেখা যায় আরব দেশগুলোর বাদশারা চিকিৎসা নিতে সুইজারল্যান্ড কিম্বা ফ্রান্সে যান। তাছাড়া,  আফ্রিকার নেতারা এদিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। আলজেরিয়ার সদ্য ক্ষমতাচ্যূত প্রেসিডেন্ট বুথেলিকা দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন ফ্রান্সে। অ্যাঙ্গোলায় ৩৮ বছর ক্ষমতায় থাকা জোসে এডওয়ার্ডো ডস সান্টোস চিকিৎসা নিতেন স্পেনে। জিম্বাবের মুগাবে বিশ্বের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে যেতেন সিঙ্গাপুরে। সম্প্রতি নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুহারি এজন্যে বিপুলভাবে সমালোচিত হয়েছেন। তবে, প্রেসিডেন্ট বুহারি তাঁর চিকিৎসার সময়ে ভাইস-প্রেসিডেন্টের কাছেই দায়িত্বভার দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে, এসব দেশের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে দেশগুলো হয় রাজতান্ত্রিক, নয়তো কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন।

গণতন্ত্রের দেশগুলোর রাষ্ট্রকাঠামো নির্বাচিত নেতাদের চিকিৎসায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ। গণতন্ত্রে চিকিৎসা সেবাসহ সবধরণের সেবাব্যবস্থাতেই প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার শক্তিশালী ব্যবস্থা আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতাদের যখন-তখন ক্ষমতাচ্যূতির ঝুঁকি যেমন থাকে না, তেমনই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ঝুঁকির বিপরীতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও থাকে যথেষ্ট। ফলে, কোনোপক্ষেরই আস্থাহীনতার সমস্যা হয় না।

ব্রিটেনে চিকিৎসা করানোর সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের আলী। ডঃ মোদাচ্ছের আলী বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং তিনি এর আগে প্রধানমন্ত্রীর চোখের চিকিৎসা করেছেন বলে জানা যায়। সুতরাং, ডঃ মোদাচ্ছের আলীরও  সাইকোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছে কিনা - এমন প্রশ্ন অবশ্য খুবই যৌক্তিক।

শুরুতে মুরফিল্ডসে আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম। সেটা অবশ্য ব্যাতিক্রম বলেই আমার ধারণা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক বিকালে চোখের এক জটিল সমস্যার কারণে হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে আমি হাজির হই। আমার সৌভাগ্য যে রোগ-নির্ণয়ে ভুল ধরা পড়ায় অস্ত্রোপচারের টেবিলে শোয়ানোর পরও আমি একটা বড় অঘটন থেকে রেহাই পাই। অপারেশনের ঠিক আগে চক্ষুশল্যবিদ দলের যিনি কনিষ্ঠ, তিনি রোগের ধরণ সম্পর্কে তাঁর ভিন্নমতের কথা জৈষ্ঠ্য বিশেষজ্ঞকে জানানোর পর আমাকে দ্বিতীয়দফা পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেই পরীক্ষার পর কনিষ্ঠ চিকিৎসকের সিদ্ধান্তই সঠিক বলে চূড়ান্ত হয়। তবে, অপারেশনের টেবিল থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ছমাস ধরে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরা আমাকে জানান যে ঐ রোগের কোনো ওষুধ নেই এবং অস্ত্রোপচারেও সুফল মিলবে না।

মুরফিল্ডসের নামডাক বিশ্বজুড়েই। সুতরাং, আমার হতাশাটাও ছিল অনেক। তবে, কিছুদিনের পরই সাহস করে আমি একদিন আমার ব্যাক্তিগত চিকিৎসক (জিপি)র কাছে জানতে চাইলাম তিনি আমাকে অন্য কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারেন কিনা। তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং আমাকে পাঠালেন রয়্যাল ফ্রি হসপিটালে। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন আপনার হারানোর কিছু নেই। বরং, কিছুটা সুফল মিললেও মিলতে পারে। তাঁদের কথাই সত্যি হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...