সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল। 

এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়।


এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগে আন্দোলন দমনের কৌশল অনুসরণের কথাটি স্মরণে রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকারের ভূমিকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষণেই বরং নজর দেওয়া শ্রেয়। প্রথমেই বলা দরকার আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও পর্যায় আছে, যা সহজেই আলাদা করা যায়। যেমন এ আন্দোলন শুরুর পর প্রথম প্রায় দিন দশেক কোনোরকম বাধার মুখে পড়েনি। এমনকি রাজধানী বিভিন্ন সড়ক, আন্ত:জেলা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখার পরও পুলিশ তাদের হঠিয়ে দিতে শক্তিপ্রয়োগ করেনি, কিম্বা অনুমতি আছে কি না, সে প্রশ্ন করেনি। 


আমার নিজের ধারণা হয়েছিল, দেশের অর্থনীতি যখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ যখন ব্যপক, তখন সরকার এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবে না, যাতে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো একই কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। আমাদের সবার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো, না কি সরকার বড় একটি ভুল করলো, তা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু সরকারের ভূমিকায় যে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। 


একটু আগে যে বিভিন্ন পর্যায়ের আলাদা আলাদা বৈশিষ্টের কথা বলছিলাম, তার দ্বিতীয় পর্বটির শুরু রোববার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে। কোটা সংস্কারের দাবির নিষ্পত্তি আদালতের উপর ছেড়ে দেওয়ার যে কৌশল সরকার অনুসরণ করে আসছিল, তা থেকে সরে এসে আন্দোলনকারীদের প্রতি যে মন্তব্য করা হয়, তা শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদেরর নাতি–নাতনিদের সুযোগ না দিয়ে কি রাজাকারের নাতি–নাতনিদের সুযোগ দিতে হবে – মন্তব্যকে আন্দোলনকারীরা তাদের জন্য অবমাননাকর হিসাবেই গণ্য করেছে। কারো মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও আদর্শের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে এই তকমাকে তো অবমাননা মনে করার কথা নয়। 


দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যরাতেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আন্দোলনকারীরাও পরিহাস করে বিভিন্ন রকম শ্লোগান দেয়। প্রযুক্তির অভাবনীয় ক্ষমতার কল্যাণে এসব ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত দেশ ও দেশের বাইরে সম্প্রচারিত হতে থাকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়েছে দেখে অন্যরাও তাদের নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিবাদে মুখর হয়। মুহুর্তের মধ্যেই নতুন নতুন শ্লোগান সৃজিত হয় এবং সবচেয়ে জোরালো আওয়াজ ওঠে, ’চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। এটি আন্দোলনকারীদের মূল মনোভাব হলেও সরকার সমর্থকেরা দ্বিগুণ উৎসাহে তা বিকৃত করে তাদের রাজাকার হিসাবে অভিহিত করতে শুরু করে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনকারীদের কোণঠাসা করা এবং অপাংক্তেয় প্রমাণ করা। প্রশ্ন হচ্ছে, বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি কি এসব রাজনৈতিক পদক্ষেপ তদন্ত করতে সক্ষম? 


আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে এই বিভ্রান্তি তৈরিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীরাও বেশ উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। দলের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথিত অবমাননার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত বলে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়ার পরই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ পরিচয়ে সশস্ত্র হামলা চালানো শুরু হয়। সাধারণ ছাত্রীদের উপর চড়াও হওয়ার যেসব ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা নজিরবিহীন। আর মঙ্গলবার ছাত্রলীগের পাশাপাশি পুলিশকেও মারমুখী ভূমিকায় দেখা যায়, যার পরিণতি রংপুরে পুলিশের কাছ থেকে সরাসরি গুলিতে সাঈদের প্রাণহানি। এগুলো হচ্ছে রক্তপাতের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের বেপরোয়া কৌশলের বৈশিষ্ট্য।   


অতীতেও রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব ধরনের আন্দোলন দমনে সরকারবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও রাজাকার বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ পরিচয়ে সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলন কিম্বা ছাত্র–ছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের স্মৃতি নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। তবে এবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যপকতা স্পষ্টতই অনেক বেশি বিস্তৃত ও গতিপ্রকৃতিতে অনেক ভিন্নতা আছে। দেখা যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা  আন্দোলনে সমর্থন দিলেও তাদের কোনো সভায় বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বোঝা যায় এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, আন্দোলনে যেন দলীয় রাজনীতির ছাপ না পড়ে। 


কোটা সংস্কারের সমস্যার উৎস এবং ঘটনাক্রম থেকে প্রমাণ মেলে আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিশেষ করে বিএনপি–জামায়াতের ষড়যন্ত্র হিসাবে চিত্রায়িত করে চলেছে। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি–নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করে। এই পরিমাণ অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য চলে আসা কোটার চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা ছিল এবং তা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ অতীতে হয়নি। কিন্তু সেই সুবিধা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্তে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। 


যেসব কারণে এই নতুন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনা ওঠে, তা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি–নাতনিরা অনগ্রসর নন। বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের বংশধরদের জন্য বৈষম্যের জন্ম দেওয়া কার্যত: তাদের চেতনার পরিপন্থী। সর্বোপরি বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করায় সুবিধালোভীরা ভুয়া সনদ সংগ্রহে যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তা–ও ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সুপরিচিত লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ যেমন লিখেছেন, তাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধ করেছেন ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু সেই সংখ্যা এখন দুই লাখ (পরিবার) ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের  আমলেই প্রমাণ মিলেছে মন্ত্রী ও সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকেই সরকারি সুবিধার লোভে  ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন।  


এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা শুনে আসলেও এ সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসংস্থান হয়নি। ফলে চাকরির বাজারে সুযোগের দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকার পরিপত্র জারি করে কোটা স্থগিত করলেও সংস্কারের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি সচিবদের কমিটির সুপারিশও ফাইলচাপা থেকেছে। 


পরিপত্র জারির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদনকারিরা সুবিধাভোগী বা প্রত্যাশী। হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের কথা বললেও সরকার কোটার হার নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী বলে রায় দিয়েছেন। যদিও অনেকে মনে করেন কোটা থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ধারণের এখতিয়ার সরকারের। আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ার সময় আইনমন্ত্রীর কথায়ও তা পরিষ্কার। সুতরাং বিষয়টি যে সরকার আগেই সমাধান করতে পারত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। হাইকোর্টের আদেশের ওপর আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ হওয়ায় আদালতের বাইরে বিষয়টির সন্তোষজনক সমাধানে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। 


ঘটনাক্রম থেকে তাই প্রমাণ মেলে যে এই অনাকাঙ্খিত ও দু:খজনক পরিস্থিতির দায় শুধুমাত্র সরকারের। সময়ক্ষেপণে কোনো অন্যায্য সিদ্ধান্তই যে ন্যায্যতা পায় না, সেটি সরকার যদি দ্রুত উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো, তাহলে এত মৃত্যু , নিপীড়ণ ও ধ্বংস দেখতে হতো না।  


(১৯ জুলাই, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত)



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...