তথ্যমন্ত্রীর
বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করার সুযোগ খুব একটা হয়
না। কিন্তু, গত ২৬ ডিসেম্বর তিনি যা বলেছেন তাঁর জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি
সেই বক্তব্যকে সমর্থন জানাতেই হয়। তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ
বলেছেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যেসব কথা বলেছেন, তা তাঁর পদত্যাগ করে বলা
উচিত ছিল। পদে থেকে এ ধরনের কথা বলা আত্মপ্রবঞ্চনা।
তথ্যমন্ত্রী যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও পুরো কমিশনের
উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলতেন তাহলে আমরা তাঁর কথার প্রতি আরও জোরালো সমর্থনদিতে পারতাম। কেননা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়ে বলেছেন ‘নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হবে। ভোটারদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমরা নেবো। তারা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন, সেই
নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করবো। তাই আহ্বান করবো-ভোটাররা যেন ভোট দিতে আসেন।‘ তাঁর এই কথাতেই স্বীকারোক্তি
মেলে অতীতে তাঁরা ভোটারদের নিরাপত্তাও দেননি, নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে করতে পারেন নি।
এর আগে গত ৮ মার্চ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী কর্তাদের
এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে
সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না। তবে, সেদিন তিনি একথাও বলেছিলেন যে “কারা সেজন্য দায়ী,
তাদেরকে কী করা যাবে… সেই দীক্ষা-শিক্ষা
দেওয়ার ক্ষমতা যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ কোনো নেই যে, কী
কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী।” (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)।
নির্বাচনের
৬ মাস পর গত জুলাইয়েও নির্বাচন কমিশন যখন তার ওয়েব সাইটেও একাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ২১৩টি ভোট কেন্দ্রে
ভোট পড়েছে শত ভাগ৷ তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলেন,
‘‘শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক
কোনো ঘটনা নয়৷ তবে আগে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেনি৷ গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর আর কিছু করার থাকে না (ডয়েচে ভেলে
১০ জুলাই, ২০১৯)৷'' গত
একবছরে কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও নানাভাবে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
ভোটের পবিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থ কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থার যে সর্বনাশ সাধন করেছেন তার
স্বীকারোক্তিগুলো এতোদিন হয়তো মন্ত্রীর নজরে আসেনি। এখন যেহেতু নির্বাচন কমিশনার মাহবুব
তালুকদারের আত্মপ্রবঞ্চনা তাঁর নজরে এসেছে আমরা কি তাই আশা করতে পারি যে এবার পুরো
কমিশনের আত্মপ্রবঞ্চনা তাঁর নজরে আসবে এবং তিনি তাঁদের সবার পদত্যাগ দাবি করবেন?
নির্বাচন
কমিশনের অযোগ্যতা ও খোলামেলা পক্ষপাতে একমাত্র ক্ষমতাসীন দল ছাড়া সবারই রয়েছে হতাশা
ও ক্ষোভ। এমনকি, তাঁদের জোটসঙ্গীদেরও অনেকেই প্রকাশ্যে এবিষয়ে একাধিকবার মুখ খুলেছেন।
তবে, দূর্ভাগ্যজনকভাবেএকথাও সত্য যে দেশের প্রধান বিরোধীদল এতোটাই রক্তশূণ্যতায় ভুগছে
যে এবিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর সামর্থ্যও তারা হারিয়ে ফেলেছে। গত একবছরে এই কমিশনের পদত্যাগের
দাবিটাও তারা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেনি। মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিকে
অগ্রাধিকার না দিয়ে দলটি বরং একের পর এক নির্বাচনী প্রহসনে অংশ নিয়ে চলেছে। আসন্ন সিটি
করপোরেশন নির্বাচনেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না। ভোটের পবিত্রতা রক্ষায়
ব্যর্থতার দায় নিয়েও তাঁরা কী আশায় নাগরিকদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন তাও বোঝা ভার।
নির্বাচনে
অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ নিয়ে তাঁরা যে একটা কার্যকর আইনী লড়াই করতে পেরেছেন তাও নয়।
রকিব কমিশনের অধীনে ঢাকার গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও যে কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের
উৎসব হয়েছিল তা নিয়ে বিএনপি আইনী লড়াইয়ের কথা বলেছিল। ওই নির্বাচনের মেয়ররা তাঁদের
মেয়াদ পুরণ করেছেন , কিন্তু নির্বাচনীবিরোধের আইনগত প্রতিকারের কোনো চেষ্টাই দেখা গেল
না।
সম্প্রতি
নাগরিক সংগঠন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)এক বিবৃতিতে নির্বাচন
কমিশনারদের অপসারণ ও কমিশন পুর্নগঠনের দাবি জানিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে তাদের
এই
সাম্প্রতিক বিবৃতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই নেই। অথচ, সংস্থাটির দূর্নীতির সূচক এবং
অন্য কয়েকটি রিপোর্ট নিয়ে গত তিনদশকে সময়ে সময়ে কতো রাজনীতিই না হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর
দেওয়া বিবৃতিতে টিআইবি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ
সব কমিশনারদের আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই উল্লেখ
করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে‘। কারণ হিসাবে সংস্থাটি বলেছে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে তা অভূতপূর্ব ও গোটা
জাতির জন্য বিব্রতকর ।
নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় একজন কমিশনারের অনৈতিক হস্তক্ষেপ এর অভিযোগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কমিশনের
অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরের পটভূমিতে টিআইবি এই বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে তারা বলেছে, এই
নির্বাচন কমিশন দেশকে এক অভূতপূর্ব নির্বাচনের দায় চাপিয়ে দিয়েছেন, যার পরতে পরতে অনিয়মের
অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো তদন্ত হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনাররা এবং
সচিবালয়ের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে জনগণের করের টাকা হরিলুট করেছেন এমন অভিযোগ
উঠেছে। কিন্তু তারপরও ছিল অস্বস্তিকর নিরবতা। ব্যর্থতা
এবং নৈতিক স্খলনের দায় নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্যান্য কমিশনাররা যে সরে
যাবেন না সেটা এতোদিনে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাঁরা তাঁদের শপথের অবমাননা করছেন,
সংবিধান অবমাননা করছেন। টিআইবি রাষ্ট্রপতির প্রতি এই বিতর্কিত ব্যক্তিদের দ্রুত অপসারণের
পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা
এ পর্যন্ত যত অনিয়ম হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তার তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও আহ্বান জানিয়েছে।
এবারে
কমিশন কিম্বা সরকার যেমন ওই বিবৃতির কোনো প্রতিবাদ করেনি, তেমনই বিরোধী দলগুলোও ট্রান্সপারেন্সির
বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। কমিশন এবং সরকারের নীরবতার কারণ হিসাবে ধরে নেওয়া অন্যায়
হবে না যে এসব গুরুতর অভিযোগের কোনো জবাব তাঁদের কাছে নেই। এগুলোর সবই সত্য। প্রশ্ন
হলো, নির্বাচনব্যবস্থায় আস্থা পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার পটভূমিতে নাগরিক
সমাজের তরফে যে উদ্বেগ ও দাবি জানানো হয়েছে তার আলোকে আদৌ কি কোনো নাগরিক আন্দোলন গড়ে
উঠবে?
( ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন