সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিএনপি শনাক্তে মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি কোন আইনে

সাম্প্রতিক কিছু দৃশ্য খুবই পীড়াদায়ক এবং অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর কারণ, পুলিশের সাম্প্রতিক কিছু ভূমিকা্। বিশেষত, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে জনগণের অবাধে চলাচলের স্বাধীনতায় নির্বিচার হস্তক্ষেপ এবং যেখানে–সেখানে তাঁদের শরীরে ও ব্যাক্তগত জিনিসপত্রের তল্লাশির মত মানবিক মর্যাদাহানিকর পদক্ষেপ। গণপরিবহন কিম্বা ব্যাক্তগত যান, কোনোকিছুতেই ছাড় মেলেনি এবং তা শুধু ঢাকায় প্রবেশের সময়ে: বেরোনোর সময়ে নয়। রাস্তায় রাস্তায় তল্লাশিচৌকি বসিয়ে এধরণের গণহারে তল্লাশি আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরের নিরাপত্তা অভিযানের চেয়েও বেশি ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়।  


এরকম আরেকটি পীড়াদায়ক দৃশ্য হচ্ছে, মানুষের মুঠৌফোন হস্তান্তর এবং তাঁদের ব্যক্তিগত বার্তা ও ছবি দেখাতে বাধ্য করার মাধ্যমে গণহারে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন। এগুলো সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মোবাইল যোগাযোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনারও পরিপন্থী।  মোবাইল ফোন এখন আর শুধু দূরালাপনের মাধ্যম নয়, এতে মানুষ তার ব্যাক্তগত নথিপত্র এবং একান্ত ব্যক্তিগত ও পরিবারিক ছবিও সংরক্ষণ করে থাকে, যা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়া বা আদালতের নির্দেশ ছাড়া অন্য কারও দেখার অধিকার নেই । অথচ মোবাইল ফোন দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তার বাহক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধমত পোষণ করেন না। মোবাইল ফোনের এ রকম অবৈধ তল্লাশি এবং পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুধু পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছাত্রলীগের সদস্যরাও তা করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। পুলিশ এসব তৎপরতা তো বন্ধ করেইনি, উপরন্তু ছাত্রলীগের কর্মীরা কয়েকজনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে পুলিশ ছাত্রলীগ কর্মীদের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন করেনি? ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো যদি এরকম বেসরকারি নজরদারি দল গঠন করতে পারে, তাহলে তা কি বিরোধী দলগুলোকেও একই ধরনের কাজে উৎসাহিত করবে না?


বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এখন আমাদের বেশ কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। বিএনপির যে  সমাবেশ বেশি হলে সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা স্থায়ী হতো, তার জন্য ঢাকার এক কোটিরও বেশি নাগরিকের কম করে এক দিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে চার দিন পর্যন্ত নানাধরণের ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। মানুষের  দৈনন্দিন রুটিন, যেমন অফিসের কাজ, কেনাকাটা, পার্কে বা বিনোদনকেন্দ্রে যাওয়া, ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট কোচিং, ডাক্তার দেখানো, সামাজিক অনুষ্ঠানা ও অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় কাজের ক্ষতি হয়েছে। দাঙ্গাবিরোধী সাঁজোয়া যান, জলকামান, একে ৪৭–ধারী বিশেষ বাহিনী সোয়াটের শহরের কিছু অংশে টহলের ছবিগুলো ছিল  অনেকটা  রণক্ষেত্রের মতো, যা গণতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না। ঢাকায় বিদেশী মিশনগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য যে সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে বা উদ্বেগ–উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছে, তাতে আমাদের মন্ত্রীরা যতই বিরক্ত বা ক্ষোভ প্রকাশ করুন না কেন, সেগুলো মোটেও অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক ছিল না। 


বিএনপির সমাবেশে যোগদানের জন্য শায়েস্তা করার যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে যে বিপজ্জনক প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে তা হলো ক্ষমতাসীন দল অনুমোদন করে না এমন কোনো কর্মকাণ্ড তারা করতে দেবে না। দলের কার্যালয়ের সামনে জনসভা অনুষ্ঠান নিয়ে যা হলো, তাতেই এর প্রমাণ মেলে। 


নয়াপল্টনে গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত অর্ধডজন জনসভা করতে দেওয়ার পর ঢাকার পুলিশ কমিশনার বিএনপির আবেদনের বিষয়ে কেন দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না?  নয়াপল্টন ও তার  আশপাশের এলাকায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ হওয়ার ঘটনা গত কয়েকসপ্তাহে সহনীয় হলেও ১০ ডিসেম্বরে সহনীয় না হওয়ার ব্যাখ্যা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয়? বিএনপিকে নয়াপল্টনে কোনো সভা করতে দেওয়া হবে না, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হবে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ঘোষণা দেওয়ার পরই ডিএমপি প্রধান নয়াপল্টনের বদলে সোহরাওয়ার্দিতে সভা করতে বলেন। ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক কিছু অনুষ্ঠানের কর্মসূচির কথাও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। সুতরাং, নয়া পল্টনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা তার আগের চার সপ্তাহে কেন করা হলো না? সোহরাওয়ার্দি উদ্যান নিয়ে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও পুলিশের এক সুরে কথা বলা বিএনপিকে যে সন্দেহপ্রবণ করে তুলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সমাবেশের অধিকার যেহেতু সংবিধানস্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার, সেহেতু বিরোধী দলের এ অধিকার অস্বীকার বা ক্ষুণ্ণ করার নির্দেশ যদি  কোনো উচ্চতর কর্তৃপক্ষও দিয়ে থাকে, তবে তা  হবে সংবিধানের পরিপন্থী এবং পুলিশ কমিশনার তা  মানতে বাধ্য নন।  


বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পুলিশ যে ভূমিকা পালন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক। মূল প্রশ্নটি অবশ্য অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং ছবি থেকে মনে হয় বিকল্প জায়গার প্রশ্নে বিএনপির নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় পুলিশ কমিশনারের বদলে গোয়েন্দা (ডিবি) প্রধানই ছিলেন মূখ্য ভূমিকায় । এই ডিবিই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও আরেকজন জৈষ্ঠ্য নেতা মির্জা আব্বাসকে রাতেরবেলায় তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া – এ এক নতুন নজির তৈরি হলো। রাতেরবেলায় রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার কোনো নতুন বিষয় নয়, তাঁদের কোমরে দড়ি পরানোরও নজির আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে কোনো রাজনীতিবিদকে ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আর কোনো নজির আমাদের মনে পড়ে না।     

 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আকস্মিক অভিযানের জন্য যে কারণ দেখিয়েছে পুলিশ, বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে পুরো ঘটনাটিকে সাজানো বলে দাবি করেছে। নিজেদের অফিসের সামনে সমাবেশের পরিকল্পনা নিজেরা নস্যাৎ করতে তারা নাশকতার পরিকল্পনা করবে, এমন দাবির যৌক্তকতা প্রমাণ সহজ নয়।   সুতরাং, বিষয়টিতে একটি স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। 


বিএনপির ঢাকা সমাবেশের সময় পুলিশের ভূমিকায় আবারও চরম বৈপরীত্য উন্মোচিত হয়েছে। একদিকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিএনপিকে ঢাকার রাস্তায় সমাবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালেও আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে রাজধানীজুড়ে রাস্তায় ডজন ডজন প্যান্ডেল স্থাপন করে সমাবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে কাউকে যেতে না দিলেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে চুলা বানিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছে, পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি। কেন এই দ্বৈতনীতি, পক্ষপাত? এই প্রশ্নগুলি আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত এবং আইনের শাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। 


(১২ ডিসেম্বর, ২০২২–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...