সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আওয়ামী লীগে অবাধ্যতার ভালো–মন্দ ও দায়

 গত কয়েকদিন ধরে অধিকাংশ সংবাদপত্রে মন্ত্রী–এমপিদের স্বজনদের দলীয় নির্দেশ অমান্য করার খবর প্রধান শিরোনাম হচ্ছে। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে পৌঁছানোর পর উপজেলা নির্বাচনের নামে যে আরেকটি সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন চলছে, তা নিয়ে খুব একটা প্রশ্নের অবকাশ নেই। 


রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে এখন অরাজনৈতিক পরিচয়ে ভোটের আয়োজন হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। অথচ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের জ্বালা কী, তা তো আওয়ামী লীগের বুঝতে আর বাকি নেই। সম্ভবত: সে কারণেই উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার তাগিদটা তারা বেশ জোরালোভাবেই অনুভব করেছে। 


দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক বিরোধীরা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী হবে, এমন ধারণাও হয়তো প্রবল ছিল। এখন বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার উপায় কী? সংসদ নির্বাচনে ডামি প্রার্থী দিয়েও তো একদলীয় নির্বাচনের অভিযোগ থেকে রেহাই মেলে নি। সুতরাং, মন্ত্রী–এমপিদের ক্ষমতার প্রভাব থেকে নির্বাচনকে মুক্ত রাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁদের পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরা প্রার্থী হলে মন্ত্রী–এমপিরা যে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতারও অবকাশ রাখবেন না, সেই আশঙ্কা দ্রুতই বাস্তব হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাই তাদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। 


সমস্যা হলো, নির্দেশ দিলেও তা কেউ মানছে না। সমকাল পত্রিকা লিখেছে, দলের কেউ কথা না শোনায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা হতাশ। হতাশ হওয়া ছাড়া সম্ভবত তাঁদের আর কিছু করার নেই। কেননা, যাঁরা নির্দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনার সুযোগ কই? 


রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার অর্থ তো এই নয় যে যখন দলীয় পরিচয় নির্বাচনের জন্য আবশ্যক নয়, তখন দলের কারণে কেউ ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার হারাবে। আবার পরিবারের কেউ মন্ত্রী বা এমপি হলে শুধু সেই কারণে কোনো ব্যক্তির নির্বাচন করার মতো মৌলিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো আইন নেই। 


আমরা কমিউনিষ্ট পার্টিতে মনোলিথিক দল বলে একটা বিশেষণ শুনতাম, যেটা জামায়াতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে সেরকম অটুট শৃঙ্খলার এককেন্দ্রিকতার প্রচলন ছিল না। কমিউনিষ্ট পার্টি বা জামায়াতের মতো দলে কর্মীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা এতটাই জলাঞ্জলি দিতে হয় যে দলের সদস্যের বিয়ে বা  চাকরির জন্যও দলের অনুমোদন লাগে। কমিউনিস্ট পার্টি আর জামায়াতের তাই নির্বাচন নিয়ে দলীয় শৃঙ্খলার কোনো সংকট নেই। কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা আগেই বলেছে, আর জামায়াত অংশ নিয়েও হঠাৎ এক রাতেই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করেছে। বিএনপির ক্ষেত্রেও কয়েকজনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের একই রকম নির্দেশনা অমান্য করার খবর দু–একটি কাগজে আছে। 


প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের এই সংকট কেন? এর উৎস কী? এই সংকটের জন্ম যে আওয়ামী লীগের নিজের তৈরি, সে বিষয়ে বোধহয় কেউই দ্বিমত করবে না। গত সংসদ নির্বাচনে অনৈতিক সুবিধা নিতে দলীয় গঠনতন্ত্রের বিধি লংঘন করে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের ডামি প্রার্থী হতে দলের নেতৃত্ব যে উৎসাহ যুগিয়েছিল, সে কথা নিশ্চয়ই সবার স্মৃতিতে এখনও তাজা আছে। 


তা ছাড়াও অতীতে যাঁরা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে দলে ফেরত নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ধারণা তৈরি হয়েছে যে এসব সাংগঠনিক অপরাধ দলের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুতরাং, যাঁরা দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশ মানছে না, তাঁরা কেন এর অন্যথা করবেন? 


তবে এর মধ্যেও লক্ষ্যণীয় যে বিষয় সবার নজর কেড়েছে, তা হলো  যাঁরা নির্দেশ অমান্য করছেন, তাঁরা মন্ত্রী–এমপিদের স্বজন – কেউ পুত্র, কেউ স্ত্রী, কেউ ভাই, আবার কেউ পরমাত্মীয়। আরও যে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, তা হলো তাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার সবরকম চেষ্টাই হচ্ছে। 


নাটোরের সিংড়ায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের পরমাত্মীয় সে কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপহরণের মতো অপরাধ সংঘটনেও পিছপা হননি। অপরাধের মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় সমালোচনার মুখে তাঁকে  মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রার্থী অপহরণের ঘটনার কি নিষ্পত্তি হয়েছে? অপহরণে ব্যবহৃত  আওয়ামী লীগ নেতার গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার হলেও কোনো মামলা হয়নি বলে লিখেছে ইত্তেফাক। এরকম অপরাধের বিচারে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের যে দায়সারা ভূমিকা, তা তো অদৃশ্য ক্ষমতার প্রভাবেই। 


প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রী–এমপিরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও কেন পরিবারের সদস্যদের উপজেলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই চেষ্টা। এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। সংসদ সদস্যারা আইনপ্রণেতার বদলে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার শাসকে পরিণত হয়েছেন। এই পরিবর্তনেও একটি বড় অবদান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। উপজেলায় সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টার ভূমিকা নির্ধারণ করে সব এলাকার উন্নয়ন ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে তাঁদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফি বছর সংসদ সদস্যদের জন্য আলাদা বিশেষ বরাদ্দও আছে। ’এমপিরাজ’ প্রতিষ্ঠায় যাতে কেউ কোনো বাধা তৈরি করতে না পারে, তাই বশংবদ উপজেলা প্রশাসন তো তারা চাইবেনই। গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো ভেঙ্গে পড়ার পরিণতি এর থেকে আলাদা আশা করার কোনো ভিত্তি আর অবশিষ্ট নেই।  

  

আওয়ামী লীগের কিছু মন্ত্রী–এমপির এই যে বেপরোয়া মনোভাব, যাকে কেউ কেউ স্পর্ধা বা অবাধ্য গণ্য করেন, তাকে অনেকে আবার স্বাধীন অবস্থানও ভাবতে পারেন। এর অন্য আরেকটি দিকও রয়েছে। এই স্বাধীনচেতা মনোভাব বা আস্পর্ধা দ্রুতই দলের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। কেননা স্বাধীনতার প্রবণতা খুব সহজেই ছড়ায়। গণতন্ত্রে সেটা একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। যে কারণে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার সংবিধানের ৭০ ধারা তুলে দেওয়ার দাবি ওঠে। 


সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে নিজস্ব মনন ও বুদ্ধিবিবেচনায় বিভিন্ন আইন তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন, সেটাই গণতন্ত্রে প্রত্যাশিত। উন্নত গণতন্ত্রে ভোট দেওয়ার জন্য এমপিদের ওপর হুইপের প্রয়োগ তাই খুবই সীমিত এবং নিজের দলের এমপিরা যে প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণে মোটেও পিছপা হন না, তার অজস্র নজির দেখতে পাওয়া যায়। 


বাংলাদেশে অবশ্য প্রধান দুই দলে ক্ষমতার যে কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তাতে এরকম অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা এমপিরা নিকট ভবিষ্যতে পাবেন, এমন আশা দূরাশাই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃত্বের জন্য তাই উদ্বেগের কিছু নেই। তবে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা এবং আত্মঘাতী হানাহানি যে বাড়ছে, তার দায় অন্য কারো নয়, একান্তই দলটির নিজস্ব। 


(২৫ এপ্রিল, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...