সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সবার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারের পতন

 টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং দমন–পীড়নের নির্লজ্জ রূপ প্রদর্শন করে ১৫ বছর ৭ মাস প্রধানমন্ত্রীত্ব ধরে রাখার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী শাসকদের কাতারে নিজের অবস্থান পাকা করেছেন। ছাত্র–গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাঁর অনুগত বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী পর্যন্ত তাঁকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এক বছর আগে, ঠিক এই দিনে, তিনি পদত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভারতে চলে যান। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিনই গণভবন, সংসদ ভবনসহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তাঁর ও পরিবারের নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ সদস্যদের অস্ত্র ও সরঞ্জাম লুট হয়ে যায় (সূত্র: ইত্তেফাক, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

জনতার ক্ষোভের মাত্রা বোঝাতে এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট নয়। জুলাই ও আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনের আন্দোলনের হতাহতের পরিসংখ্যান এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে জনগণ আর চুপ করে থাকার অবস্থায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটাপুনঃবহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের প্রতিবাদে ছাত্ররা ১ জুলাই রাজপথে নামে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বিদ্রূপ করে মন্তব্য করেন, "মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা না পেলে রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?" ওই রাতেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে স্লোগান তোলে: “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!”, “কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার!”

পরদিনই ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা চালায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর, যেখান থেকেই সহিংসতার সূচনা। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশি গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে শহীদ হন ওয়াসিম আকরাম। সেদিন মোট পাঁচজন শিক্ষার্থী শহীদ হন। এরপর সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন যৌথভাবে রক্তক্ষয়ী দমনপীড়ন চালায়: কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, ব্লক রেইড চালিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারসহ নানা অপারেশন পরিচালনা করে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে দলীয় সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ১,৪০০। অন্যান্য হিসাবে আহত ১০,০০০-এর বেশি। পাঁচ শতাধিক মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, ১৩৩টি শিশুর প্রাণ গেছে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন শ্রমজীবী মানুষ। তবুও মানুষ রাজপথ ছাড়েনি; শহীদদের দাফন করে তারা আবার বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। কবির ভাষায়, “জনতা সাগরে জেগেছে উর্মি টালমাটাল” — এ এক অপ্রতিরোধ্য সত্যে পরিণত হয়েছে।

১৯ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৯ দফা দাবি পেশ করে। এরপর আন্দোলনের পরিধি বাড়তে থাকে। ঢাকার অলিতে–গলিতে, জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী, অভিভাবক সবাই ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হন। ৩ আগস্ট ঘোষণা আসে এক দফা—শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এই এক দফাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্য, যা অবশেষে বিভিন্ন মতাদর্শের দলগুলোকেও একত্রিত করে; এমনকি ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যে বামপন্থীরা দেড় দশক ধরে কোনো ধরণের আন্দোলনে শামিল হতে চায়নি, সেই অসম্ভবকেও সম্ভব হতে দেখা যায়। 

স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের যে প্রত্যাশা, তা তরুণ প্রজন্মের ওপরই নির্ভরশীল। অনেকে একে বলছেন ‘বাংলাদেশ ২.০’। কিন্তু, এই নতুন বাংলাদেশের রূপ কেমন হবে, সে প্রশ্ন এখনও উন্মুক্ত। স্বপ্নদ্রষ্টা তরুণ, নিপীড়িত রাজনৈতিক কর্মী, বিপ্লবী কিংবা নৈরাজ্যবাদী — সকলের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল স্বৈরতন্ত্রের পতন; কিন্তু তার স্থলে কী আসবে, সে বিষয়ে ঐক্য তখনও ছিল না, এখনও বহুলাংশেই অনুপস্থিত।

এই অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠিত হয়, যারা ৪৫ দিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে এবং ২৩ দিন সর্বদলীয় আলোচনায় সময় ব্যয় করেছে। যে রাজনীতিকেরা এক টেবিলে বসতেও রাজি ছিলেন না, তারা আজ নয়টি মূল বিষয়ে একমত হয়েছেন এবং অন্যান্য বিষয়ে মতপার্থক্য কমিয়ে এনেছেন — এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রণয়ন প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ।

জনগণের ধৈর্যচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। এই হতাশার পেছনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু দায়ও রয়েছে। গত এক বছরে সরকার অনেক কিছু করতে চেয়েছে, কিন্তু সবক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ যথাযথ ছিল না। যেসব ক্ষেত্রে উপদেষ্টারা তাঁদের ব্যতিক্রমী কাজে সফল হয়েছেন , সেগুলোর সুফল দৃশ্যমান নয় বা তাঁরা তা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। উপদেষ্টাদের অনেককেই নিষ্ক্রিয় বলে মনে হয়, যা জনআস্থার সংকট বাড়িয়ে তুলেছে।

১৮ কোটি মানুষের দেশে অপ্রত্যাশিত ঘটনা অসম্ভব নয়। কিন্তু যখন সরকার প্রতিক্রিয়াহীন, অপ্রস্তুত, কিংবা দর্শকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়— তখন সবাই তার পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যে তুলনা টানবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিপ্লব বা গণঅভ্যূত্থানের পর তাই প্রয়োজন হয় দৃঢ় ও দক্ষ নেতৃত্ব। কেননা মানুষ নেতৃত্বের মধ্যে দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রত্যাশা করে।

সে কারণেই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চলমান প্রক্রিয়াটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই ধারা এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে অন্তত গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ সার্থক হবে।

(৫ আগস্ট, ২০২৫–এর আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...