সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও আর্থিক স্বচ্ছতা কত দূর

ফেব্রুয়ারির ১৫ থেকে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুরো ছয় মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিনিময় এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এটি একটি বড় কৃতিত্বই বলতে হবে। অবশ্য স্বাধীনতার ৫৪ বছরের প্রথম কয়েক বছর বাদ দিলে প্রায় পুরোটা সময়ে রাজনীতি প্রধানত: যে দ্বিদলীয় বৃত্তে আবদ্ধ ছিল, তার একটি পক্ষ এখন পলাতক। তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় বহুপক্ষীয় আঙ্গিকে রাজনীতির প্রতিদ্বন্দিতা ও সহযোগিতার নতুন রুপ দেখা যাচ্ছে। 


প্রায় ডজন তিনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা ম্যারাথন আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো, সংসদ, নির্বাচন ও  বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয়ে প্রহণযোগ্য কিছু সংস্কারের অঙ্গীকার করবেন বলে কথা রয়েছে। এটি আশা জাগানো অগ্রগতি। সব কটি বিষয়ে সবাই একমত না হলেও তাঁরা যে রাজপথে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বদলে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে সক্ষম, তার প্রমাণ দেওয়ায় তাঁদের সাধুবাদ প্রাপ্য। 


তবে হতাশারও যে অনেক কারণ ঘটছে, সেকথাও বলা দরকার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নৈরাশ্যের বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের সংস্কারের প্রশ্ন প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারত, তাহলে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয় নিয়ে সত্যিকার অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হতো। অন্তত ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদারের মুখে শুনতে হতো না, ’নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা অঘটন ঘটে গেছে, একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। এটার জন্য আমরা সবাই দায়ী।’ 


২০০৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগেই সব রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা। কোনো দল সেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছে – এমন কোনো আলামত মেলে না। এখনো কেউ এ বিষয়ে দৃঢ় কোনো অঙ্গীকার করতে আগ্রহী বলে মনে হয় না। সংসদের সংরক্ষিত আসনসংখ্যা প্রতীকিভাবে বাড়ানোর আলোচনাতেই তা আটকে আছে। দলের মধ্যে নারী যদি তার অবস্থান শক্ত করতে না পারেন, তাহলে সংসদে কোটা পূরণে স্ত্রী–কন্যাদের মনোনয়নের ধারা চলতেই থাকবে এবং আমরা সংসদে বন্দনা=সংগীত শুনতে থাকবো। 


সর্বদলীয় আলোচনায় অংশ নেওয়া অন্তত দুটি দল থেকে অতীতে সংসদে যাঁরা নারী সংসদ সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন, আশা ছিল, তাঁরা তাঁদের দলে নারী অধিকারের এজেন্ডা নির্ধারণে সফল ভূমিকা রাখতে পারবেন এবং তা ঐকমত্য কমিশনে প্রতিফলিত হবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের দাবি নিয়ে যেসব দল সক্রিয় আছে, সেসব দলেও দূর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো অগ্রগতি নেই। 


গত জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানে এত বিপুলসংখ্যক ছাত্রীকে আমরা সরব দেখে আশা করেছিলাম, আন্দোলনপ্রসূত নতুন রাজনৈতিক দলে অন্তত তাঁদের জোরালো প্রতিনিধিত্ব থাকবে। দু–একটি আলোচনায় তাঁদের উপস্থিতি দেখা গেলেও কার্যকর অর্থে তা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এটিও রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সাংগঠনিক সংস্কারবিমুখতার নমুনা। 


রাজনৈতিক দলের সংস্কারের আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাজনীতির অর্থায়ন। কেননা, বহুদিন ধরেই রাজনীতিকে কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করার আলোচনা চলছে। ২০০৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালায় কিছু সুনির্দিষ্ট বিধি পালনের কথা বলা আছে। কিন্তু এসব প্রতিপালন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আবার বিধিমালা মানা না হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, বা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তার কারণ কী – এসব প্রশ্নেরও উত্তর প্রয়োজন। 


সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আয়–ব্যয়ের যেসব হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা পড়েছে, তা থেকেও বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে, ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা জানান, ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৮টি দল আয়–ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের আয় ও ব্যয় অন্য সব দলের চেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে দলটির আয় হয়েছে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ২৯৯ টাকা। আর দলটি এ বছর ব্যয় দেখিয়েছে ২৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৭৭ টাকা।

নিবন্ধন বাতিল হওয়ার আগে ২০১৩ সালে সর্বশেষ আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। এরপর চলতি বছর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় এক যুগ পর আবার হিসাব দিল দলটি। তবে নিবন্ধন না থাকলেও দলটি যেহেতু গতবছরের আগস্টের শুরুর ৩/৪ দিন বাদে সক্রিয় ছিল, সেহেতু ওইসব বছরের আয়–ব্যয়ও অপ্রাসঙ্গিক নয়।  

বিএনপি যে আয়ে–ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির মোট আয় ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪২ টাকা। একই সময়ে দলটির ব্যয় ৪ কোটি ৮০ লাখ ৪ হাজার ৮২৩ টাকা। উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ ১০ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার ১৯ টাকা। এই অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা আছে।

পত্রিকায় জাতীয় পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদেরও হিসাবও ছাপা হয়েছে। সবার হিসাব থেকেই দেখা যাচ্ছে, দলগুলোর কেউই অর্থকষ্টে ছিল না, সবারই উদ্বৃত্ত আছে। এটি ইতিবাচক খবর। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর হিসাব থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই দলগুলোকে অনুদান হিসাবে কিম্বা অন্য কোনো কারণে কে, কত টাকা দিচ্ছে? ছোট ছোট চাঁদার বাইরে অন্য যে কোনো থোক সহায়তার সূত্র দলগুলোর স্বেচ্ছায় প্রকাশ করা উচিত। ব্যক্তিগতভাবেও রাজনৈতিক নেতারা এ ধরনের সহায়তা নিলে তার তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। দলের নামে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো তাহলে বন্ধ করা সম্ভব হতো। পুরোপুরি বন্ধ না হলেও দলীয় নেতৃত্বের এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। 

নির্বাচন কমিশনের যে নির্ধারিত ছক আছে, তাতে অবশ্য এ সব তথ্য চাওয়া হয় না।  কেন হয়না, তা বোধগম্য নয়। আবার রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের যে বিধিমালা আছে, তাতে বলা আছে রাজনৈতিক দলগুলোর আয়–ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের সই করা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আয় ও ব্যয়ের হিসাব পরিচালনার জন্য দলটির কোনো ব্যাংক হিসাব নেই।

নতুন নিবন্ধন চেয়েছে – এমন দলগুলোর যারা এই শর্ত পূরণ করেনি কমিশন তাদের চিঠি দিয়েছিল বলেও খবর বেরিয়েছে। জামায়াতের ক্ষেত্রে এখন কী ব্যবস্থা নেয় কমিশন, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। জামায়াতের ক্ষেত্রে বিষয়টির আলাদা তাৎপর্যও রয়েছে। এই একটি দলই জানিয়েছে যে তারা নির্বাচনের প্রার্থীদের অনুদান দিয়েছে ১১ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪২০ টাকা, অর্থাৎ প্রার্থী প্রতি গড়ে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা করে। পুরোনো নির্বাচনী আইনে প্রার্থীদের সব আয়–ব্যয় ব্যংক হিসাবের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইন বদলানো হলে ভিন্ন কথা। না হলে দলটি এবং দলের প্রার্থীরা কি ইতিমধ্যেই বিধি ভঙ্গ করেছেন? 

সবশেষে সব দলের জন্যই প্রযোজ্য প্রশ্ন হচ্ছে, নাগরিকরা উদ্ধৃত্ত আয় না থাকলেও নির্দিষ্ট আয়সীমা অতিক্রম করলে যেহেতু কর দিতে বাধ্য, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর আয় কেন করযোগ্য হবে না? ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে লোকসান হলেও কর রেয়াত নেই। অনেকক্ষেত্রেই অগ্রিম কর দিতে হয়। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কর দিতে হয় এবং সম্প্রতি কংগ্রেসের বর্ধিত কর দাবির বিরোধ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে হেরে যাওয়ায় দলটির ঘাড়ে এখন প্রায় দুশো কোটি রুপির বোঝা চেপে আছে। 

(১৯ আগস্ট, ২০২৫–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...