সালটা
১৭৮১। ভারতে তখন ইংরেজ কোম্পানির শাসন। গর্ভণর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এবং প্রধান
বিচারপতির যোগসাজশের কাহিনী ছাপা হয়েছে ভারতের প্রথম সংবাদপত্র কোলকাতা থেকে প্রকাশিত
হিকিস বেঙ্গল গেজেটে। রাষ্ট্রের শক্তিশালী দুটি অঙ্গের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা যে
প্রায় অসম্ভব তার প্রমাণ ওই হিকিস বেঙ্গল গেজেটের অপমৃত্যু। সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ন্ত্রণের
চেষ্টা যেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই হয়ে আসছে এবং বর্তমানের শাসকরাও যে তা থেকে সরে আসেননি
তার একটা ইতিহাসভিত্তিক বিশ্লেষণ লিখেছেন সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রু ওটিস ( What India's First Newspaper Says About Democracy, 22 September, 2018, BBC Online)।
ওয়ারেন
হেস্টিংসের কাছ থেকে তখনকার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ঘুষ নিয়েছিলেন। হেস্টিংসের স্বৈরতান্ত্রিক বিভিন্ন পদক্ষেপ, অন্যায্য কর আরোপ,
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারকে আদালত বৈধতা দিত। বিচারবিভাগের
সঙ্গে সরকারের এই যোগসাজশের বিষয়ে পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তরফে তদন্ত হয় এবং গর্ভণর-জেনারেল
এবং প্রধান বিচারপতি দুজনেরই অভিসংশন হয়। বিবিসির এই প্রতিবেদন যখন পড়ছিলাম, তখন বিশ্বের
দুই প্রান্তে দুজন বিচারপতিকে নিয়ে তোলপাড় চলছে। একজনের স্বপ্নভঙ্গের বিবরণ , ‘অ্যা ব্রেকেন ড্রিম : রুল অব
ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি‘ নামের বই নিয়ে; আর, অপরজন, ব্রেট কাভানার সুপ্রিম কোর্টে
নিয়োগের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মনোনয়ন পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে সহপাঠীকে
ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ নিয়ে।
প্রথমজনের
বই নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য এবং একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনা
শুনে ধারণা হয় যে বইটিতে যেসব গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সেগুলো নিয়ে তাঁদের খুব একটা মাথাব্যাথ্যা
নেই। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মনোযোগ বইয়ের সারবস্তুতে নয়, বরং, এর রচয়িতা
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও চরিত্রহননে। তাঁরা যে বিচারপতি সিনহার মর্ম:পীড়া বা ‘অর্ন্তজ্বালা‘র বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাতে বিস্মিত
হওয়ার কিছু নেই। একজন (মেয়াদ পুরো করার সুযোগ থেকে) বঞ্চিত ব্যাক্তির ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক
এবং সেই জ্বালা মেটাতেই তিনি নানাধরণের বেসামাল ও মনগড়া কথা বলছেন – এমন যুক্তি দলীয় সমর্থকদের
জন্য খুবই জরুরি। নাহলে, বিচারপতি সিনহার অভিযোগগুলো তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করলে
তাঁদের মনোবল এবং সমর্থন র্দূবল হতে শুরু
করবে। ‘নির্বাচনের আগে তিনি বইটি প্রকাশ
না করলেও পারতেন‘ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে তা স্পষ্ট। আরও লক্ষ্যণীয় হচ্ছে আইনের শাসন রক্ষায় যাঁরা সর্বদা সোচ্চার তাঁদের চাইতেও এই বইয়ের বিষয়ে বেশি সরব ক্ষমতাসীন দল ও তাঁদের সমর্থকরা।
সরকার
কিম্বা ক্ষমতাসীন দলের এই প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত। কেননা, দফাওয়ারী অভিযোগগুলোর জবাব
দিতে গেলে অভিযোগগুলোই সামনে চলে আসবে এবং তার অনেকগুলো খন্ডন করাও কঠিন। উদাহরণ হিসাবে
বলা যায় বিচারপতির সিনহার অসুস্থতার জন্য ছুটি নেওয়া এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার
দাবির কথাটি। দেশছাড়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের কাছে একটি লিখিত বিবৃতি দিয়ে যেতে সক্ষম
হয়েছিলেন, যাতে তখনই তিনি বলেছলেন যে তিনি অসুস্থ নন। তখন যে তাঁর সঙ্গে কাউকে দেখা
করতে দেওয়া হচ্ছিলো না – সেকথাও তখনকার সংবাদমাধ্যমে
প্রচারিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবি সমিতির নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা
করলে তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও তখন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সরকারের তরফে বিচারপতি
সিনহার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগগুলো জোরে-শোরে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টাতেই তাই এখন
তাঁদের মনোযোগ।
বিচারপতি
সিনহার বিরুদ্ধে দূর্নীতির যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার প্রত্যেকটিই গুরুত্বর্পূণ। সুপ্রিম
কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণের বিধান ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের
রায় ঘোষণার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হয়। এর আগে অবশ্য সরকারসমর্থক একটি
দৈনিক পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী সা কা চৌধুরীর মামলার রায়ের
প্রাক্কালে আসামীপক্ষের লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগ এনেছিল।সরকার চাইলে সেই সময়েই
রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাতে পারতো। কিন্তু, তখন
তেমন কিছু হয় নি। বরং, বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে ওই অভিযোগের
জন্য পত্রিকাটির সম্পাদক-প্রকাশক ও সাংবাদিককে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে।
টিভি চ্যানেলটিকেও তখন আদালত সতর্ক করে দেয়। বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ
থাকার পরও সরকার কেন তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং বিচারের ব্যবস্থা
করছে না সেই প্রশ্ন (এই নিবন্ধের লেখক কর্ত্তৃক একাধিক নিবন্ধে উত্থাপিত) আমরা বহুবার
করেও কোনো সদুত্তর পাইনি। কিছুদিন আগে বিচারপতি সিনহার ব্যাংক হিসাবে বড় অংকের টাকা
জমা দেওয়ার তথ্য নিয়ে দূর্নীতি দমন কমিশনের গলদঘর্ম হওয়ার খবরও আমরা জানি। ওই অভিযোগ তদন্তে দুই ব্যাক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর কমিশন
আর মামলার পথে পা বাড়ায় নি (৭ মে ২০১৮, দৈনিক ইত্তেফাক)। এখন আবার সেই অভিযোগ তদন্তে
দুদক তৎপর হয়েছে।
আমরা
জানি না অন্য অভিযোগগুলো ঠিক না বেঠিক। যেসব অভিযোগের নথি দেখে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা
তাঁর সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, সেগুলোর জন্য তাঁরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল
করে অভিযোগগুলো তদন্ত এবং বিচারের কোনো ব্যবস্থা নেন নি। আবার, অভিযোগগুলো গুরুতর বলা
হলেও তাঁকে বিদেশে যেতে দিয়ে বিচার এড়ানোর সুযোগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।
সুতরাং, যথার্থভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে আদালতে বিচার না করে তাঁকে অপরাধী অভিহিত করাটা
আসলে তাঁর বইয়ে সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো উপেক্ষা করার কৌশল কিনা?
বাংলাদেশের
সংবাদমাধ্যম এখন এক অস্বস্তিকর সময় পার করছে তা আমরা সবাই জানি। স্বপ্নভঙ্গের বইটির
অনেককিছুই সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয় নি। অত্যন্ত সাদামাটা ইংরোজিতে এবং প্রায় কোনোধরণের
সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এই বইটির ঠিক কত কপি সামাজিক মাধ্যমে বা ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে
দেশে-বিদেশে মানুষের কাছে পৌঁছেছে তা অনুমান করাও মুশকিল। একাধিক টিভি চ্যানেলে বইটি
নিয়ে যে বিতর্ক তার ওপর ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা হয়েছে। এরকম একাধিক আলোচনা শুনে বিস্মিত
হলাম একারণে যে আলোচকরা শুরুতেই বলে দিচ্ছেন যে বইটি তাঁদের পড়া হয় নি। একজন সঞ্চালক,
বিচারপতি সিনহার সঙ্গে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িত হওয়া একজন সাবেক বিচারপতিকে টেলিফোনে যুক্ত
করে তাঁর কাছ থেকে বইটির বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ (অবজেকটিভ) বিশ্লেষণ শুনতে চাইলেন। সাংবাদিকতার
এই দৈন্য অত্যন্ত দু:খজনক। অথচ, বইতে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনবর্হিভূতভাবে বিচারিক
ক্ষমতা অপপ্রয়োগের অভিযোগ করেছেন বিচারপতি সিনহা। ওই বিচারপতিকে তাঁর সম্পর্কে উত্থাপিত
অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ না করায় ধারণা করা অন্যায় হবে না যে সঞ্চালক বইটি না
পড়েই তা নিয়ে আলোচনা সঞ্চালন করছিলেন।
বইটির
সমালোচনায় লেখকের ভাষাগত দূর্বলতা কিম্বা তার সম্পাদনার মানের প্রশ্ন যেমন উঠছে তেমনই
উঠছে এটি প্রকাশের পিছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কিনা। নির্বাচনের প্রাক্কালে এধরণের
প্রকাশনায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ
সাংবিধানিক একটি পদে প্রায় বছর তিনেক দায়িত্ব পালনকারী ব্যাক্তিটির আত্মজীবনীতে যেসব
গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সারবস্তুর দিক থেকে সেগুলোর কোনটিই উপেক্ষণীয় নয়। বিচার
বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ।
বইটিতে
যেসব ঘটনাবলীর বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তার অনেকগুলোই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের থেকে
আলাদা কিছু নয়। তবে, বাড়তি হিসাবে নেপথ্যের যেসব ঘটনা বইটিতে যুক্ত হয়েছে তা সাধারণের
কাছে ছিল অজানা। এসব ঘটনার পাত্রপাত্রীরা দায়িত্বশীল সাংবিধানিক পদে আসীন আছেন। এঁদের
কেউ কেউ রাজনীতিক হলেও সবাই নন। তাঁর সহকর্মী বিচারপতিদের কথাও আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায়
নিয়োজিত বিশেষ বাহিনীর ভূমিকার কথাও আছে। এঁদের অনেকের বৈধ-অবৈধ ক্ষমতার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের
কথা আছে। তাঁর নিজের নিয়োগসহ অন্য কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান বিচারপতির নিয়োগ, নিম্ন আদালতে
নিয়োগ-বদলির নেপথ্যের কথা আছে। বইটির লেখক যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তখন আদালতের কার্য্যক্রমে
যেসব অনিয়মের কথা তিনি লিখেছেন তার ফলে সেসময়কার কোনো কোনো রায় যে প্রশ্নবিদ্ধ হবে
না সেকথা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে? অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধির প্রশ্নে ব্যাক্তিভেদে
যে আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে তা কী উপেক্ষণীয়? সুতরাং, ন্যায়বিচারের স্বার্থে এসব অভিযোগ
– তথা বইটির সারবস্তু নিয়ে আলোচনার
প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা কি ঠিক হবে?
গোড়ার
দিকে যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মনোনীত ব্রেট কাভানার বিরুদ্ধে
যৌন অপরাধের অভিযোগসম্পর্কিত বিতর্কের কথা বলেছিলাম। বিচারপতি নিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের
এই পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মনোনীত ব্যাক্তির অতীতকে নিবিড়ভাবে যাচাই করার এই
সুযোগ দেশটির সব নাগরিকের জন্যেই উন্মুক্ত। যাঁরা এখন বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে অনৈতিক
বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনছেন তাঁরা যদি গত দশবছরে বিচারপতি নিয়োগের একটি স্বচ্ছ্বরীতি
নির্ধারণের আইন করতেন তাহলে কি এমন একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হোত? বিচারপতি নিয়োগের
আইনের আগে অপসারণের আইন তৈরি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমুক্ত ছিলো না সেকথা কি আর বলার অপেক্ষা
রাখে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন