প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান
মোহাম্মদ নুরুল হুদাকে ধন্যবাদ। মাত্র দু‘মাসের ব্যবধানে তিনি অন্তত একটা সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন। দেশের বৃহত্তম স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের
দিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন যে ‘ভোটকেন্দ্রে ভোটার না আসার দায় রাজনৈতিক দলগুলোর
এবং প্রার্থীদের। এ দায় নির্বাচন কমিশনের নয়।‘ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় সরকারের
কাছে স্বাধীনতা বিসর্জনের পর তিনি যে ভোটারহীন সিটি নির্বাচনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা
করেছেন সেজন্য এই কৃতজ্ঞতাটুকু তাঁর প্রাপ্য। ভোটাররা যে ভোটকেন্দ্রে আসেননি এই সত্যটির
স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দেওয়ার পাশাপাশি তিনি যদি আরেকটু সাহসী হয়ে বাকি সত্যটুকুও বলতে
পারতেন তাহলে তাঁকে আমরা আরো বড় করে ধন্যবাদ দিতে পারতাম।
বাকি সত্য
যেগুলো তিনি বলতে পারতেন, কিন্তু বলেন নি, তার মধ্যে সবার আগে আসে – ভোটারদের ভোটকে মূল্যহীন করে ফেলার কথা। এই কাজটিতে নিজেদের দায় স্বীকার করার
মত সাহস তাঁর কাছ থেকে কেউই আশা করে না। কিন্তু, এই কাজটিতে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন
এবং আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী যে গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের মত করতে পারলো না সেটুকু
অন্তত তিনি বলতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন জাতীয় নির্বাচনের মত আগের রাতে ব্যালট বাক্স
ভরে রেখে ভোটের দিন ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রের সামনে
জটলা তৈরি করে রাখলে ভোটার উপস্থিতির এই করুণ দশা দেখতে হতো না। জাতীয় নির্বাচনের আগে
সংলাপে নানারকম আশ্বাস দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিদ্বন্দিতায় টেনে আনতে প্রধানমন্ত্রী
যেভাবে সফল হয়েছিলেন, সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু একটা করলে
প্রতিদ্বন্দিতাটা অংশগ্রহণমূলক করা যেত।
সিইসি হুদা
এদিন আরও বলেছেন, আমরা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে দিই। রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা প্রার্থীদের
ভোটার নিয়ে আসতে হয়। তিনি বলতে পারতেন যে জাতীয় নির্বাচনে বিরোধীদল ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট
দিতে না পারার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তারা প্রায় অস্তিত্ত্বহীন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে
ক্ষমতাসীন দলের উপদলগুলোর প্রতিদ্বন্দীরাই কমিশনের তৈরি করা সুষ্ঠু পরিবেশের সুযোগ
নিয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ করতে পারতেন, যেমনটি তাঁরা উপজেলার ক্ষেত্রে করছেন।
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফা অনুষ্ঠানের আগেই তাই কমিশন দুজন এমপিকে (ওমর ফারুক চৌধুরী
এবং আব্দুল কুদ্দুস) তাঁদের এলাকা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
জাতীয় নির্বাচনে
যেসব অনিয়ম, কারচুপি, জবরদস্তি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে তার ওপর জানুয়ারির গোড়াতেই
বাম জোটের গণশুনানিতে আমরা বিভিন্ন বিচিত্রধরণের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। এর প্রায় দেড়
মাস পর ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান প্রতিদ্বন্দী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের কথা শোনা
গেল গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাদের আয়োজিত গণশুনানিতে। সেখানে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে
ভোট এবং চোখ হারানো সিরাজগঞ্জের মেরি বেগম বলেছেন ‘দেশবাসীকে বলব, চোখ হারিয়েছি
আমার দুঃখ নাই। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ, আমি ৩০ তারিখে ভোট দিতে পারি নাই।---আমি দাবি
জানাতে চাই, আমি ভোট দিতে চাই, আমাকে ভোট দিতে দেন নইলে আমার দুই চোখ ফেরত দেন।’ মেরি বেগম বিএনপির প্রার্থী রুমানা মাহমুদের সমর্থক।
ভোটের অধিকার
ফিরিয়ে দেওয়ার এমন আর্তি অন্য যে কোনো ‘স্বাভাবিক সময়ে‘ সংবাদপত্রের প্রথম পাতার শীর্ষসংবাদ
হতো। কিন্তু, সময়টা এখন অস্বাভাবিক। নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের নাগরিক সমাজের
অগ্রগণ্য অংশ অন্য যেকোনো সরকারের সময়ে সরব হলেও এখন ততটা সোচ্চার নন এবং তা হতেও চান
না। বিএনপির রাজনীতিকে অস্পৃশ্য গণ্য করাই হয়তো এর একটা বড় কারণ। তাছাড়া, বিএনপির নেতৃত্বাধীন
ঐক্যফ্রন্টের ষাটোর্ধ নেতাদের প্রাণশক্তি ও বাস্তববোধ সম্ভবত এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
তা নাহলে, বামফ্রন্ট যে কাজটি দশ দিনে করতে পারে সেটা করতে তাঁদের সাত সপ্তাহ সময় লাগার
কথা নয়।
খান মোহাম্মদ নুরুল হুদা যে নির্বাচনে ভোটারদের গরহাজির থাকার জন্য রাজনৈতিক
দলগুলোকে দায়ী করেছেন সেই নির্বাচন সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন
বলেছেন ‘ভোটারদের অংশগ্রহণ ও বিজয়ীকে দেখে আমি অবাক হইনি। যেভাবে নির্বাচনটি
হয়ে গেল, তাতে এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচন কমিশন ও তাদের ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের
আস্থা উঠে যাওয়ার একটি প্রকাশ ছিল এই নির্বাচন।‘ নির্বাচন পরিচালনায় পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জনের পরও দেশ-বিদেশের
নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর পিএইচডি করায় সাখাওয়াত
হোসেনের বিশেষজ্ঞ মতামতকে উপেক্ষা করা যায় না। সিটি করপোরেশন নির্বাচন এমন হওয়ার কারণ
হিসাবে তিনি বলছেন, ‘গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
পর মানুষ নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ ঢাকা
উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের ছায়া হিসেবে দেখেছে। ফলে তারা
ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আমাদের
দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা যতটুকু দাঁড়িয়েছিল, তা খারাপ হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে
ভোটাররা আর এর ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না।‘
ফিরে আসি
আমাদের নির্বাচন কমিশনারের প্রশংসায়। তাঁদের বিবেক ও সাহসের তারিফ না করে পারা যায়
না। নির্বাচন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার চৌদ্দটা বাজানোর পর কমিশন আয়োজন করেছিল পিঠা
উৎসব। আর, ২ মার্চ তারা ঘটা করে পালন করেছে জাতীয় ভোটার দিবস। দিবসটির জন্য তাঁরা এবছর
একটি শ্লোগানও (কমিশনের ভাষায় বিষয়) প্রচার করেছেন , যাতে বলা হয়েছে ‘ভোটার হব ভোট দিব‘। জানুয়ারিতে আমরা দেখলাম প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বৈধ
নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ
ও দমন-পীড়নের স্বীকৃতি দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেওয়ার এক নতুন দৃষ্টান্ত। সেটি
করল সরকার। নির্বাচন কমিশনই বা কম কিসে? নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুর উপহাস করায় তাঁরা
যে পিছিয়ে নেই জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপন তা্রই নজির। এটি কী কমিশনের রসবোধের পরিচয় বহন
করে, নাকি অন্যকিছু?
‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি
তাকে দেব‘ শ্লোগানের আমদানি হয়েছিল গত আড়াই দশকেরও আগে। তার পরিণতিতে আমরা পেয়েছিলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এরপর আর্বিভাব ঘটে ভৌতিক ভোটারের । ভোটার তালিকায় কোটিখানেক
ভৌতিক ভোটারের নাম অর্ন্তভূক্তির পরিণতিতে আসে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং স্বচ্ছ্ব ব্যালট
বাক্স। দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ব্যালটবইয়ের মুড়িতে
আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে স্বচ্ছ্ব ভোটবাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা কার্য্যকর সমাধান হিসাবে
কাজ করলেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাকে তা অনিশ্চিত করে ফেলে। ফলে, ভোট ব্যবস্থাপকদের যে স্বাধীনতা
ও নিরপেক্ষতা প্রয়োজন সেটি কেড়ে নেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অবসান
ঘটিয়ে। দলীয় সরকারের অধীনে ডিজিটাল পরিচয়পত্র, ভোটের বইয়ে আঙ্গুলের ছাপ কিম্বা স্বচ্ছ
খালি বাক্সের প্রয়োজন হয় না। কেননা, ভোটের হার ৩১ কিম্বা ৯০ শতাংশ যা-ই হোক তা তো আর
যাচাইয়ের প্রশ্ন আসছে না।
জাতীয় ভোটার
দিবস উদযাপনের খবরাখবর দেখে ধারণা হয় যে এবার প্রবাসীদের ভোটার করার একটা উদ্যোগ কমিশনের
বিবেচনায় রয়েছে। সন্দেহ নেই ‘ভোটার হব ভোট দিব‘ শ্লোগান তুলে এবার কমিশন কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের হিড়িক পড়বে। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের দাবি অনেকদিনের। কিন্তু, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার আগে দেশে থাকা নাগরিকদের তাঁরা যে ‘ভোটধিক্কার‘ (ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার বিষয়টির বর্ণনায় সাংবাদিক শামসুদ্দিন আহমেদের উদ্ভাবিত বিশেষণ) দিয়েছেন তার প্রতিকার কী? জাতীয় রাজনীতিকে প্রতিদ্বন্দিতাহীন করে একমুখী করে ফেলার পর নিম্নস্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার্পূণ রাজনীতি বজায় রাখার আশা কিম্বা প্রবাসীদের ভোটে আকৃষ্ট করার অভিযান মুমূর্ষ গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে একেবারেই অর্থহীন। ভোটার দিবসের বদলে মেরি বেগমের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিলে বরং আমরা সত্যি সত্যিই কৃতজ্ঞ হতাম।
(৪ মার্চ ২০১৯‘র প্রথম
আলো পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকের কলাম।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন