৭০‘এ মাওলানা ভাসানি ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর‘
আওয়াজ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু, আক্ষরিক অর্থে ভোটের
বাক্সে তখন কেউ লাথি মারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল
একাধিকবার নির্বাচন বর্জন করলেও কাউকে ভোটের বাক্সে লাথি মারতে দেখা যায়নি। কিন্ত এবারের
ডাকসু নির্বাচনে তেমনটি ঘটেছে। নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা এমন
ঘটনা ঘটিয়েছেন। নানা অঘটনের এই নির্বাচনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন, সরকার
এবং ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাড়া প্রায় সবাই প্রহসন বলে অভিহিত করেছেন।
এমনকী, বর্তমান উপাচার্যের পূর্বসুরি এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী শিক্ষকরাও তাঁদের
লজ্জা এবং হতাশার কথা বলেছেন।
পরদিন মঙ্গলবার,
১২ ফেব্রুয়ারি, দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে দেশের দুজন আলোচিত চরিত্রের
সংমিশ্রণে একটি ক্যারিকেচার ছাপা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান
এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান মোহাম্মদ নুরুল হুদার – দুজনের মুখের অর্ধাংশ মিলিয়ে এটি আঁকা হয়েছে। এঁরা দুজনে দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে
যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার বাস্তবতা তুলে ধরতেই ওই কার্টুন। এর নীচের শিরোনাম ছিল ‘অ্যাজ উই স‘। নির্বাচনব্যবস্থাকে কলংকিত করার অভূতর্পূব নজির সৃষ্টিতে তাঁদের দুজনের মধ্যে
যে অদ্ভুত মিল ওই ব্যঙ্গচিত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে, এঁদের দুজনের এই মিল শুধু
যে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী জালিয়াতিতে সহায়তা করায় তা নয়। সত্য অস্বীকার করে কাল্পনিক
ভাষ্য তৈরির সৃজনশীলতায়ও তাঁদের সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়।
নির্বাচনে
ছোটখাটো অনিয়ম ও ত্রুটির অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু, ডাকসু নির্বাচনে যেসব
অনিয়ম ও কারসাজির কথা প্রকাশ হয়েছে তার তুলনা কেবলমাত্র দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত
জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গেই করা চলে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য আর জাতীয় নির্বাচনে
প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর আনুগত্য একইরকম।জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট
সহযোগীরা যেসব সুবিধা পেয়েছেন, ডাকসুতে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে তার চেয়ে
বেশি ছাড়া কম পান নি। বেশি সুবিধাগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা যায় অস্বচ্ছ্ব ভোটের বাক্স,
ব্যালটে কোনোধরণের সিল-ছাপ্পড় না থাকা (আসল-নকল যাচাইয়ের ব্যবস্থাহীন), ছাত্রলীগ নেতাদের
নিয়ন্ত্রণাধীন হলে হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, পোলিং এজেন্টের উপস্থিতির সুযোগ না দেওয়া
ইত্যাদি।
কুয়েত মৈত্রী
হল রাতেরবেলায় ভোটের বাক্স ভরে রাখার ঘটনাটি ধরা না পড়লে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মডেলটিই
যে সফলভাবে বাস্তবায়িত হতো, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রোকেয়া হলের তিন বাক্স ব্যালট
উদ্ধারের ঘটনাটিকে সরকারবিরোধীদের ব্যালট ছিনতাইয়ের চেষ্টা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা
ও মামলায় সেরকমই ইঙ্গিত মেলে। শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের রাতভর ভোটের কক্ষ পাহারা
দেওয়া এবং সব আসনে সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের জয়লাভে ইঙ্গিত মেলে যে কারসাজিমুক্ত
ভোটের ফলাফল কী হতো। বস্তুতপক্ষে, মেয়েদের হলগুলোর সবকটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের
প্রাধান্য একটি প্রবণতার স্বাক্ষ্য বহন করে। অনেকে ছাত্রীদের এই প্রবণতাকে একেবারেই
আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, ছাত্রীদের থেকে ছাত্রদের
ভাবনা ভিন্নধর্মী হওয়ার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।
ছাত্রীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্ন কোনো গোষ্ঠী নন। তাঁদের বঞ্চনা বা ক্ষোভ ছাত্রদের থেকে আলাদা
হওয়ার কথাও নয়। তাঁদের হলের খাবারের মান, কক্ষের আসবাবপত্র, লাইব্রেরি সুবিধা, কমনরুমের
ক্রীড়াসামগ্রী ও জীবনমান ছাত্রদের হলগুলোর তুলনায় খারাপ এমন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন
সময়ে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা যে বেশি লাঞ্ছিত হয়েছেন তাও নয়। তাঁরা রাজনৈতিকভাবে বেশি
সংগঠিত এমনটিও কেউ দাবি করছেন না। যৌক্তিকভাবে ধারণা করা যায় ছাত্রীদের হলগুলোতে শেষপর্যন্ত
যেভাবে ভোট হয়েছে তাতে তাঁরা অনেকটাই স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পেরেছেন,
যেটা ছেলেদের হলগুলোতে সম্ভব হয় নি।
ছেলেদের হলগুলোতে
তা না হওয়ার নজিরগুলো ভোটের দিনেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ভিপি নুরুল হক নিজেই
মহসিন হলে ঢুকতে পারেন নি, কেননা তা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করছিল। যমুনা টিভির সরাসরি
সম্প্রচারে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্টকে ছাত্রদলের প্রার্থীর একইধরণের অভিযোগ
করতে দেখা গেছে, যার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নি। অন্য কয়েকটি হলে ভোটের লাইনে
গতি শ্লথ করার কৌশল কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে
স্বচ্ছ্ব ও অবাধ ভোট হলে ভোটের প্রবণতা ছাত্রী হলগুলোর মতই হতো বলে যৌক্তিকভাবে ধারণা
করা যায়।
প্রশ্ন উঠতে
পারে, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যদি সরকারবিরোধী ক্ষোভ এতোটাই থেকে থাকে, তাহলে বিরোধী
দলগুলোর সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা কেন ভালো ফল করতে পারল না ? দৃশ্যত: অরাজনৈতিক
ছাত্র আন্দোলনকারীদের প্রতি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আস্থাপ্রকাশ বা আগ্রহী হওয়ার কারণ
কী ? দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের যে ইতিহাস ঐতিহ্য
জড়িয়ে আছে তাতে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক
প্রতিদ্বন্দী দল হওয়ায় তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলোও সমমানের প্রতিপক্ষ বলে ধারণা প্রচলিত
আছে।
কিন্তু ডাকসুতে
তেমনটি দেখা যায় নি। এর কারণ শুধুই যে ক্যাম্পসে তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি এমনটি মনে
করা যৌক্তিক নয়। আবার, বামপন্থী যে ছাত্র সংগঠনগুলো মোটমুটিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের
কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে তারাও প্রতিদ্বন্দিতায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। অথচ, গত কয়েকবছর
ধরে সাধারণ ছাত্রদের ‘গেস্টরুম‘ ভোগান্তি, হলগুলোতে সরকারসমর্থকদের রাজত্ব এবং
ভিন্নমত দমনে নিষ্ঠুরতার কারণে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হওয়ার আলামতগুলো
দৃশ্যমান ছিল। এরকম এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনোধরণের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই
দৃশ্যত অরাজনৈতিক একটি ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকে নতুন একঝাঁক নেতৃত্বের আর্বিভাব ঘটেছে।
স্পষ্টত: তাঁরাই ছাত্রদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
ছাত্র-তরুণদের এই আপাত: অরাজনৈতিক উত্থান মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। এ থেকে ধারণা
করা অন্যায় হবে না যে দেশের প্রচলিত রাজনীতি আমাদের ছাত্র-তরুণদের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করতে পারছে না। অথচ, বর্তমান
জনমিতি বলছে তরুণরাই হচ্ছে দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ।রাজনীতিক এবং সমাজতাত্ত্বিকদের
এখন গবেষণা করে দেখা উচিত চলতিধারার রাজনীতির সঙ্গে তরুণদের বিচ্ছিন্নতার (ডিসকানেক্ট)
কারণ কী ? এই তরুণরা কীধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন বিনির্মাণ করছে ? তাদের সেই
স্বপ্নগুলো পূরণের সম্ভাব্য উপায়গুলো কী ? নাকি, আমরা বিরাজনৈতিকীকরণের কোনো সংগঠিত
প্রক্রিয়ার পরিণতি প্রত্যক্ষ করছি? এধরণের বিরাজনৈতিকীকরণে কর্তৃত্ববাদীরা লাভবান হয়ে
থাকেন। তবে, এর বিপদের ঝুঁকিও তুলনামূলকভাবে
অনেক বেশি।
কোটাসংস্কারের আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন,
সরকারী চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি – এগুলোতে তরুণদের
প্রত্যাশাগুলোর ইঙ্গিত কিছুটা হলেও মেলে। কোটা সংস্কারকে কোটা বিলোপের দাবি হিসাবে
অপপ্রচার এবং আন্দোলনকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টার
করুণ ব্যর্থতায় এসব তরুণ তাঁদের লড়াকু মনোবলের প্রমাণ রেখেছেন। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের
সাফল্য প্রশ্নে যত বিতর্কই থাকুক না কেন আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রের কোথায় কোথায় মেরামত প্রয়োজন তা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এসব তরুণদের ভবিষ্যতচিন্তাকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করছে। সেখানে
শক্তিপ্রয়োগ, দমননীতি ও অপপ্রচার কোনোকিছুই এই তারুণ্যের লড়াকু শক্তিকে ধ্বংস করতে
পারেনি। মার খাওয়া তরুণ-তরুণীদের ডাকসুতে প্রধান প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠার এটাই অন্যতম
কারণ।
দ্রুততর গতিতে অতিমুনাফা লাভের আগ্রাসী পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় ২০০৮ সালের ধ্বস যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল তার পরিণতিতে গত এক দশকে থেকে থেকেই
বিশ্বজুড়ে আমরা তরুণদের প্রতিবাদ-আন্দোলন ঘটতে দেখছি। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট এবং দ্য
নাইনটি নাইন পারসেন্ট নামে এসব স্বতর্স্ফূত আন্দোলন হয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন
শহরে - বিশেষ করে আর্থিকবজারের কেন্দ্রগুলোতে। গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের
ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের দাবিতে স্কুলছাত্রদের স্বতর্স্ফূত বিক্ষোভ দেশটির মূলধারার রাজনীতিতে
আলোড়ন তুলেছিল। সম্প্রতি প্যারিসে শুরু হওয়া অসংগঠিত তরুণ এবং শ্রমজীবিদের স্বতর্স্ফূত
আন্দোলন (ইয়েলো ভেস্ট মুভমেন্ট) ইউরোপের অন্য অনেক প্রান্তেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর, অতিসম্প্রতি
শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে
স্কুলছাত্রদের নতুন আরেকটি স্বতর্স্ফূত আন্দোলন। তারুণ্যের এই প্রতিবাদী বৈশ্বিক ধারার
সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগসূত্র না থাকলেও ভবিষ্যত চিন্তা এবং স্বতর্স্ফূততায় যথেষ্টই মিল
রয়েছে।
(১৫ মার্চ, ২০১৯‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন