সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আবরারের মায়ের প্রশ্নের জবাব দিন


ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের ৫ থেকে ৬ ঘন্টার দৈহিক নির্যাতনে নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন প্রশ্ন করেছেন কোন অপরাধে তাঁর ছেলেকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো ? এই প্রশ্নের জবাব দেয়নি কেউ। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আবরার দেশের সেরা যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয় নি। সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ কোনো জবাব দেন নি। প্রশ্নটা কিন্তু আবরারের মায়ের একার নয়। এখন এই প্রশ্ন সবার দেশের সব মায়ের, সব পিতার, সব ভাইয়ের, সব বোনের।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন আরও অনেক। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর সোমবার ৭ অক্টোবর তাঁরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন আবরার ফাহাদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনায় তাঁরা থানায় জিডি করেছেন। হত্যার ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু হিসাবে বর্ণনা করার কারণটা কী কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা করবেন? আমাদের কি একথা বিশ্বাস করতে হবে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যাক্তিরা ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ড আর অপ্রত্যাশিত বা আচমকা দূর্ঘটনায় মৃত্যুর ফারাক বোঝেন না ? নাকি, ছাত্রলীগের এসব দৃবৃর্ত্তকে রক্ষার অঘোষিত দায়িত্বপালনের উদ্দেশ্যেই তাঁরা ঠান্ডা মাথার খুনিদের ঘৃণ্যতম অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা করছেন ?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোই বা আমরা কীভাবে উপেক্ষা করি? এরকম একটি নৃশংস হত্যাকান্ডের পর উপাচার্য ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াননি ( সমকাল, ৮ অক্টোবর ২০১৯)। তিনি অসুস্থ হলেও তো তাঁর পক্ষে উপ-উপাচার্য বা রেজিষ্ট্রারের মত দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের সেখানে পাঠিয়ে দু:খপ্রকাশ এবং সমবেদনা জানানো তাঁর দায়িত্ব। প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা ধরে আবরারের ওপর যখন নির্যাতন চালানো হয় তখন তো আর্ত চিৎকার হাউস টিউটর এবং প্রভোষ্টের কানে পৌঁছানোর কথা। নিশ্চয়ই আবরারকে আরও আগেই সেখান থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব ছিল না। হল প্রশাসন কীভাবে তাঁদের দায়িত্বহীনতার লজ্জা  থেকে মুক্তি পাবেন? অভিযোগ উঠেছে ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাদের রুমে রুমে টর্চার সেল চলে। এবং, সেকারণেই নেতাদের রুম থেকে চিৎকার আসলেও অন্য ছাত্ররা সেখানে এগিয়ে যেতে সাহস পায় না। আবরারের ক্ষেত্রেও সেরকমটি ঘটার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না। তাছাড়া, পূজোর ছুটির জন্যও ছাত্রদের একটা বড় অংশ বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু, এসব টর্চার সেলের অস্তিত্ত্বের কথা প্রকাশ হতে আবরারকে প্রাণ দিতে হবে কেন? হাউস টিউটর আর প্রভোস্টদের কাজ কী ? তাঁদের দায়িত্ব কি শুধু র‌্যাগিংয়ের শিকার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কিছু টেলিফোন নম্বরের নোটিস টাঙ্গিয়ে রাখা ?
হত্যাকান্ডের যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, আবরার তার ফেসবুকে কী লিখেছে, কোন মত বা আদর্শকে সমর্থন করত এসব কিছু যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। মত বা আদর্শ যাচাইয়ের কাজটি কারা করেছে? কীসের ভিত্তিতে ? বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তা ও মতাদর্শের ওপর নজরদারি এবং যে বা যাঁরা ভিন্নমতের অনুসারী তাঁদের শায়েস্তা করার দায়িত্বভার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে ? সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একদলীয় ঘাঁটি বানানোর যে প্রক্রিয়া বছরের পর বছর চলে আসছে তা কি জাতীয় রাজনীতির চলমান ধারা থেকে খুব একটা আলাদা ? আবরার ফেসবুকে ভারতকে একতরফাভাবে ফেণী নদীর পানি দেওয়ার সমালোচনা করেছে, শহীদ মিনারে কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভের ভিডিও দিয়ে তার প্রশংসা করেছে। এগুলো সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান নীতির পরিপন্থী। স্পষ্টতই: সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠন সরকারের পক্ষে এখানে লাঠিয়ালের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল এখানে কীভাবে তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করবে?
বুয়েটের এই ঘটনা যে একটি বিচ্ছিন্ন অঘটন তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমত দমনে ছাত্রলীগ যে অনেকদিন ধরেই দাপট ফলিয়ে আসছে, তা কোনো নতুন খবর নয়। এমনকি দলবাজ শিক্ষকদের যাঁরা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে আসীন হয়েছেন তাঁরাও যে অনেকক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে একই ভূমিকা নিয়েছেন তারও ভুরি ভুরি নজির দেওয়া যায়। ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো এবং সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ফেসবুকে মতপ্রকাশের জন্য ছাত্রলীগের চাপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের জেলে যাওয়া, তাঁকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি মঞ্জুরে কর্তৃপক্ষের তালবাহানা কিম্বা সরকারপ্রধানের সমালোচনার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাজার ঘটনাগুলো এখানে স্মরণ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে একাধিক শিক্ষকের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাগুলোও ভুলে যাওয়ার নয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা, বির্তক ও বহুমতের তীথর্কেন্দ্র হওয়ার কথা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের - সেগুলোকে একদলীয় করার আয়োজন বহুদিন ধরেই চলছে। তারই চরম এবং নিষ্ঠুর পরিণতি আবরারের হত্যাকান্ড।
সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন ভিন্নমতের জন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন বিএনপি বলছে ভারত সফরে দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তাই বলে কি বিএনপিকে মেরে ফেলব? বিএনপির যে নেতারা এগুলো বলছেন তাদের কি মেরে ফেলব( সমকাল, ৮ অক্টোবর, ২০১৯)? এই কথাগুলো যে বলা প্রয়োজন তা অনুভব করা এবং বলার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। এসময়ে অবশ্যই এধরণের আশ্বাসের প্রযোজন আছে। কিন্তু, এই আশ্বাসটুকুই কি যথেষ্ট ? ভিন্নমত দমনে তাঁর সরকার এবং দল কি করতে বাকি রেখেছে তা কি তিনি বলতে পারেন ? ভিন্নমত দমনে গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা, গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যা, সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার যেসব অভিযোগ গত কয়েকবছর ধরে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে সেগুলো আমরা কীভাবে ভুলে যাবো ? ব্যাপক বিরোধীতা উপেক্ষা করে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিবর্তনমূলক আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরির কথাও কি মন্ত্রী অস্বীকার করবেন ? ভিন্নমত দমনে এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার ভুক্তভোগীরাই জানেন যে এর জ্বালা কত তীব্র এবং সর্বনাশা। নাগরিকদের মতপ্রকাশের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ্য যেটি, সেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকারের গুরুত্বই বা কেন উপেক্ষিত হবে ? নির্বাচনী ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করার লক্ষ্যই তো ছিল গণতন্ত্রের নামে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
আবরারের খুনিদের বিচার করা হবে বলেও সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আবরারের খুনের যথাযথ বিচার আমাদের সবার দাবি। তবে, একইসঙ্গে আবরারের মায়ের প্রশ্নের জবাবটাও প্রয়োজন। ভিন্নমতের জন্য আবরারকে জীবন দিতে হয়েছে এই স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট নয়, এই পরিস্থিতি তৈরির দায় নির্ধারণ জরুরি। ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ এবং তা দমনে শক্তিপ্রয়োগের নীতি পরিত্যাগের অঙ্গীকারও গুরুত্বর্পূণ। জাতীয় রাজনীতির সংকটের কেন্দ্রে থাকা এসব সমস্যার সমাধানও আমাদের খুঁজতে হবে।
(৯ অক্টোবর, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...