সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জনসন-করবিন টিভি বিতর্ক: ব্রেক্সিটই কি ভোটের ফল নির্ধারণ করবে

শীতের বিষণ্নতায় নিষ্প্রভ ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনের প্রথম সপ্তাহের প্রচারে ভোটাররা যে খুব একটা উজ্জীবিত হয়েছেন, তা মনে হয় না। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি করবিন ছোট পর্দায় যে প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নেবেন, সেই আয়োজন ভোটারদের কিছুটা চাঙা করে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তাঁদের প্রথম টেলিভিশন বিতর্কটির আয়োজক বাণিজ্যিক টেলিভিশন চ্যানেল, আইটিভি। জনসন ও করবিন অবশ্য আরও একবার মুখোমুখি হবেন বিবিসির ক্যামেরায় ভোটের ছয় দিন আগে, ৬ ডিসেম্বর। ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ, ব্রেক্সিট নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে এই নির্বাচনের আয়োজন করায় যৌক্তিকভাবে ধারণা করা হয় যে নির্বাচনের ফলাফল হয়তো ব্রেক্সিট বিতর্কের সমাধান করবে।
প্রধানমন্ত্রী জনসন তাই ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) নির্বাচন হিসেবেই অভিহিত করে স্লোগান তুলেছেন ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’। তাঁকে ভোট দিয়ে পুনর্নির্বাচিত করলে স্বল্পতম সময়ে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন হবে—এটাই তাঁর নির্বাচনী বার্তা। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে ভোটারদের বিচারের বিষয় শুধু ব্রেক্সিটে সীমিত থাকছে না। করবিন এবং লেবার পার্টি এই নির্বাচনকে ভোটারদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রার সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে দলগুলোর নীতি, রেকর্ড এবং আস্থা-অনাস্থার ভোটে রূপান্তরের কৌশল নিয়েছে। বলা চলে, এই কৌশল অনেকাংশেই সফল। দীর্ঘ ৯ বছরের ‍কৃচ্ছ্রনীতির অবসান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, বৈষম্য দূর করা, সেবা খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ এবং বেসরকারি খাতকে সহায়তার বিষয়গুলো ক্রমেই নির্বাচনী বিতর্কে সামনে চলে আসছে।
যুক্তরাজ্যে সাধারণত নির্বাচন হয় গ্রীষ্মে, যখন উষ্ণ আবহাওয়ায় ভোটারদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায়। কিন্তু ১৯২৩ সালের পর ৯৬ বছরের ব্যবধানে এবার ডিসেম্বরে শীতের সময়ে নির্বাচন হচ্ছে। এমনিতেই শীতের জড়তায় বয়স্ক ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার হার কম হওয়ার আশঙ্কায় কিছুটা চিন্তিত টোরি পার্টির প্রচারপর্বের শুরুতেই ঘটেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মধ্য-উত্তরাঞ্চলীয় ইংল্যান্ডে গত সপ্তাহের আকস্মিক বন্যা এবং তা মোকাবিলায় সরকারের শ্লথগতি প্রধানমন্ত্রী জনসনের জন্য মোটেও সুখকর হয়নি। তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানেই বিরূপ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ে সরকারের প্রকাশিত তথ্যও তাঁর জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। আর সর্বসম্প্রতি মার্কিন তরুণ ব্যবসায়ী জেনিফার আরকুরির একাধিক টিভি সাক্ষাৎকার বরিসের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। মিস আরকুরি টিভি সাক্ষাৎকারে বরিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন।
বলা চলে, প্রধানমন্ত্রী জনসন অনেক প্রতিকূল পরিবেশেই টিভি বিতর্কে হাজির হচ্ছেন। তবে তাঁর জন্য সুখের খবর হচ্ছে, জনমত জরিপে তিনি এবং তাঁর দল এখনো ১৩ পয়েন্টে এগিয়ে। মূলত ব্রেক্সিট–সমর্থকদের ভোট সংহত করায় তিনি যথেষ্ট সফল বলেই মনে হচ্ছে। চরম ডানপন্থী ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকিপ) ভেঙে গত এপ্রিলে জন্ম নেওয়া ব্রেক্সিট পার্টি গত জুনের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও আগামী নির্বাচনে তাদের সমর্থন কমছে। অবশ্য, দলটি তিন শর বেশি আসনে (যেগুলো টোরি পার্টির দখলে ছিল) টোরিদের সমর্থনে সরে দাঁড়িয়েছে। আজকের বিতর্কে তাই ব্রেক্সিট প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী জনসন বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন বলেই অনেকের ধারণা।
বিপরীতে, জনমত জরিপে পিছিয়ে থাকা লেবার নেতা করবিনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্রেক্সিট প্রশ্নে অস্পষ্টতা এবং নিজের কট্টর মার্ক্সবাদী ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসা। ব্রেক্সিট প্রশ্নে লেবার পার্টির অবস্থান হচ্ছে, তারা নতুন করে ইউরোপের সঙ্গে দর–কষাকষি করে কাস্টমস ইউনিয়নের সুবিধাগুলো নিতে চায়। ওই আলোকে নতুন সমঝোতা করে তারা ছয় মাসের মধ্যে আরেকটি গণভোট আয়োজন করবে, যাতে নতুন চুক্তি অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার বিষয়ে জনমত চাওয়া হবে। তবে লেবার পার্টির অধিকাংশ নেতা ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেবেন বলে জানালেও জেরেমি করবিন নিজে কী অবস্থান নেবেন, তা বলেননি। এই অস্পষ্টতার কারণে প্রশ্ন উঠছে, তিনি কি নিজের সম্পাদিত চুক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইউনিয়নে থাকার কথা বলবেন? নাকি ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের কথা বলবেন?
করবিনের মার্ক্সবাদী ভাবমূর্তির বিষয়টিকে ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ বণিকসভা কনফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সিবিআই অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে অভিহিত করেছে। বৃহৎ পুঁজি, বহুজাতিক করপোরেশন এবং রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদেরা করবিনের অর্থনৈতিক নীতিগুলোতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন। তাঁর দল আগেই বলেছিল রেল, পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং পোস্ট অফিসকে জাতীয়করণ করবে। শুক্রবার তারা বলেছে, টেলিকম খাতে ব্রডব্যান্ড সেবাকেও জাতীয়করণ করা হবে। সারা দেশে সবাই বিনা পয়সায় ব্রডব্যান্ড পাবেন। এ জন্য বহুজাতিক গুগল, ফেসবুক, আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর করারোপ করা হবে। দাঁতের চিকিৎসায় এত দিন পয়সা দিতে হতো। তারা নির্বাচিত হলে তা দিতে হবে না। লেবার পার্টির এসব কর্মসূচি মধ্যবিত্ত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু সেবা খাতে বিপুল বিনিয়োগ এবং ব্যয়ের নীতি লেবার পার্টিকে উচ্চ কর এবং যথেচ্ছহারে ব্যয়কারী পার্টির পরিচিতিকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।
শান্তিবাদী আন্দোলনের জন্য সুখ্যাত করবিনের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষানীতি। যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠতম মিত্র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন করবিনকে নিজের দেশের জন্য খুব খারাপ বলে অভিহিত করেছেন, তেমনই ট্রাম্পের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধাও গোপন রাখেননি করবিন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি লেবার নেতা করবিনের দৃষ্টিভঙ্গিও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রবক্তা হওয়ায় তা যুক্তরাজ্যের রক্ষাকবচ (ডেটারেন্ট) নীতির বিপরীত। ফলে এসব বিষয়ে যেকোনো প্রশ্নই করবিনকে বিব্রত করতে পারে।
করবিনের সুবিধা হচ্ছে, তাঁর এসব নীতিগত অবস্থান সবারই জানা এবং সে কারণে তাঁর আন্তরিকতা এবং বিশ্বাস নিয়ে কেউ সন্দেহ করে না। যিনি তাঁর নীতি সমর্থন করেন না, তিনিও বলবেন না যে করবিনকে বিশ্বাস করা যায় না বা তিনি অসৎ। বিপরীতে, ২০১৬–র ব্রেক্সিট গণভোটে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে পার্লামেন্টের ইন্টেলিজেন্স বিষয়ক কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশে প্রধানমন্ত্রী বরিসের অস্বীকৃতি বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর কিছুটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তা ছাড়া, তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকেরই ধারণা, তিনি নির্বাচিত হতে বা ক্ষমতার জন্য যা প্রয়োজন তা–ই বলতে পারেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...