অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল ও তাঁর পরিবার ৭ কোটি টাকা কর দিয়েছেন
বলে ১৫ নভেম্বরের সংবাদপত্রগুলো আমাদেরকে জানিয়েছে। নাগরিকরা কে কত কর দেন তা আইনত:
রাষ্ট্র প্রকাশ করতে পারে না। বিপরীতে, কোনো নাগরিকই তার ব্যাক্তিগত আয় বা সম্পদের
খবর অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চান না। ব্যক্তিগত সম্পদের তথ্য প্রকাশ করে অন্য কারো
হিংসা বা লোভের শিকার হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। এতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে অবশ্য এর আংশিক ব্যতিক্রম ঘটেছে। নির্বাচনকে
অধিকতর স্বচ্ছ্ব ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করার উদ্দেশ্যে নাগরিক সমাজের উদ্যোগ এবং
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জনপ্রতিনিধি হতে হলে নির্বাচনের জন্য সম্পদের তথ্য প্রকাশ
বাধ্যতামূলক হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর সময় এটি বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচন না থাকলে এবিষয়ে আইনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু, তারপরও অর্থমন্ত্রী তাঁর এবং পরিবারের
সদস্যদের আয়কর, গতবছরের আয় এবং মোট সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করেছেণ। তিনি ডেঙ্গুজ্বরে
আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর অনেক সম্পদ মেয়েদের নামে হস্তান্তর করে দিয়েছেন জানিয়ে বলেছেন
যে একারণে এবছরে তাঁর সম্পদ কমেছে। অর্থমন্ত্রী কেন এসব স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করলেন
কোনো প্রতিবেদনেই সে প্রশ্নের উত্তর নেই। সাধারণ নাগরিকদের স্বেচ্ছায় কর দিতে উৎসাহিত
করা যদি তাঁর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি
অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং জনপ্রতিনিধি হিসাবে এই কাজটি তো তিনি আরো আগেই
করতে পারতেন।
সংবাদমাধ্যমে খবরটি যেভাবে প্রচারিত হয়েছে স্পষ্টতই তাতে তাঁর ভাবমূর্তি
কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। আমার প্রশ্ন সেখানেই। মন্ত্রীর সম্পদ ও আয়-রোজগারের হিসাব এবং
স্বেচ্ছ্বায় তা প্রকাশের খবরে মন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু, কয়েকটি
গুরুত্বর্পূণ প্রশ্ন উপেক্ষা করে গণমাধ্যম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, সাধারণ মানুষের
মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ হচ্ছে
– মন্ত্রী
হিসাবে তাঁর ব্যবসায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল কিনা? অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর ব্যবসায়
যুক্ত থাকা কতটা নৈতিক? তিনি ব্যাংক-বীমার ব্যবসায় জড়িত থাকলে ওই খাতের বিভিন্ন নীতিমালা
এবং আইন-কানুন তৈরি ও সংস্কারের সময়ে তিনি কিভাবে ব্যাক্তিগত স্বার্থের উর্ধে উঠবেন?
আমদানী-রপ্তানির ব্যবসায় যুক্ত থাকলে দেশের শুল্কনীতি নির্ধারণে তিনি কি অতিমানবের
মত নি:স্বার্থ ও প্রভাবমুক্ত থাকবেন?
সাম্প্রতিককালের বহুল-আলোচিত দেউলিয়া হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফারমার্স
ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাঁর পরিবারও ছিল। ওই দেউলিয়া ব্যাংকটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর
মাধ্যমে পুঁজি যোগান দিয়ে পদ্মা ব্যাংক হিসাবে পুর্নজন্ম দেওয়া হয়েছে। তাঁর পারিবারিক
সম্পদের যে হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকে তাঁদের লাভ-লোকসানের
খতিয়ানটাও কি পাঠকদের জানানোর দায়িত্ব গণমাধ্যমের নেই? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
সময়ে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যগুলোর সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত হিসাবগুলোর
তুলনাটাও কম গুরুত্বর্পূণ নয়।
আয়কর মেলায় কর দেওয়ার সময়ে মন্ত্রী হিসাবগুলো দেওয়ার সময়ে বলেছেন
যে তাঁর সম্পদ কমেছে এবং তাঁর চেয়ে তাঁর মেয়েরা কর বেশি দিয়েছেন। কারণ, ডেঙ্গু জ্বরে
আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর কিছু সম্পদ কন্যাদের নামে হস্তান্তর করে দিয়েছেন (যুগান্তর)।
অথচ, নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় গত নভেম্বরে তিনি দেখিয়েছেন ২০১৩ সালে তাঁর সম্পদ ছিল
৪৭ কোটি টাকা, যা ৫ বছরে ১৫ কোটি বেড়ে হয়েছে ৬২ কোটি। এবারে কর দেওয়ার সময়ে তিনি তাঁর
সম্পদের পরিমাণ বলেছেন ৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মেয়েদেরকে কিছু সম্পদ হস্তান্তরের পরও
তাঁর একবছরে সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ সৃষ্টির
জন্য তাঁর প্রশংসা পাওয়ারই কথা। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে দুটো। প্রথমত:, মন্ত্রী হিসাবে
তাঁর ব্যবসায় সক্রিয় থাকার কথা নয়। (কমিশনের হলফনামায় দেখা যায় তাঁর প্রধান আয়ের উৎস
বাড়ি ভাড়া হলেও অন্য কয়েকটি ব্যবসার মুনাফাও তাতে দেখানো হয়েছে। সুতরাং, ধারণা করা
অযৌক্তিক নয় যে ওইসব ব্যবসা থেকে তিনি এবছরেও মুনাফা পেয়েছেন।) আর, দ্বিতীয়ত: তাঁর
হিসাবে গলদ আছে, সম্পদ কমার তথ্যটি ঠিক নয়। তবে, মেয়েদের কর বাড়ার তথ্যটি যথার্থ। কমিশনের
হলফনামার সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হবে তাঁদের আয়করের পরিমাণ দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।
অর্থমন্ত্রী হিসাবে আয়করের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে মুস্তফা কামালই
প্রথম নন। তাঁর পূর্বসুরি, আবুল মাল আব্দুল মুহিতও গত কয়েকবছর ধরে ঘটা করে তাঁর করের
পরিমাণ প্রকাশ করতেন। তবে, তাঁর আয়ের উৎসটা ছিল চাকরিজীবনে অর্জিত পেনশন এবং সঞ্চয়ের
সুদ, ব্যবসা নয়। মি মুহিত অবশ্য তাঁর পরিবারের কারো তথ্য প্রকাশ করেন নি। মুস্তফা কামাল
জনসমক্ষে পরিবারের সবার আয়কর পরিশোধ করায় ধারণা করা অন্যায় হবে না যে এটি ছিল পিতৃতান্ত্রিক
সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা এবং তাঁর স্ত্রী-কন্যারা এখনও ব্যাবসায়িক বিষয়ে তাঁর ওপর নির্ভরশীল।
তাঁর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়া এবং কন্যাদের নামে সম্পদ হস্তান্তরের তথ্যে যদি কারো
ধারণা হয় যে তিনি সম্ভবত ভয় পেয়েছিলেন, তাহলে
তা কি নাকচ করে দেওয়া যায়?
জনপ্রতিনিধির
কাজটা খণ্ডকালীন নয়। তাই, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মন্ত্রীদের মন্ত্রিত্ব
গ্রহণের আগেই ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে ছুটি নিতে হয়, সাংসদেরা দ্বিতীয় কোনো চাকরি বা
পেশা গ্রহণ করতে পারেন না, খণ্ডকালীন হিসেবেও নয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বেতন-ভাতা
নিয়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ ওই সব দেশে নৈতিকতার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়।
বক্তৃতা দিয়ে ফি গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও একটা সীমা নির্ধারণ করা আছে এবং তার
বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশে তাঁরা বাধ্য। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের সব বিনিয়োগ ব্লাইন্ড
ট্রাস্ট নামে পরিচিত ট্রাস্ট গঠন করে সেখানে তা হস্তান্তর করতে হয় এবং এসব ব্যবসার
সঙ্গে তাঁরা কোনো যোগাযোগ রাখতে পারেন না। মন্ত্রিত্বের মেয়াদে সেসব বিনিয়োগের
লাভ-ক্ষতির খবর নেওয়ারও সুযোগ থাকে না।
প্রসঙ্গত:
স্মরণ করা যায় যে দুটি সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদককে আমরা মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কারণে
সম্পাদকের পদ ছাড়তে দেখেছি। এঁদের একজন হলেন ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক আনোয়ার
হোসেন মঞ্জু, যিনি এরশাদ ও শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রীসভায় যোগদানের সময় সম্পাদক পদ
ছেড়ে দিয়ে পরে আবার সম্পাদক পদে ফিরেছিলেন। শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় দ্বিতীয়বার
যোগদানের সময়েও তিনি সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন। অপরজন হলেন ৯০ এ বিলুপ্ত দৈনিক দেশের
সাবেক মালিক ও সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি মরহুম মাঈদুল ইসলাম। তাঁদের এই নজির থেকে
ধারণা হয় যে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলে ব্যবসা থেকে গুটিয়ে নেওয়ার নীতিটি বাংলাদেশে
অপ্রচলিত কিছু নয়।
তবে,
বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাটি আইন বা নীতিমালা হিসাবে আছে বলে মনে হয় না। সরকারি কোনো
প্রকাশনায় অন্তত মিনিস্ট্রিয়াল কোড বা মন্ত্রীদের আচরণবিধির কোনো তথ্য পাওয়া
যায়নি। এমন আচরণবিধি থাকলে কোনো মন্ত্রীর পক্ষেই এ ধরনের আয়-রোজগারের পথ খোলা
থাকার কথা নয়। আর যদি থেকেই থাকে, তাহলে সে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিকার নেই কেন? দূর্নীতি
দমন কমিশনের সুপারিশে আইন কমিশন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্বার্থের
সংঘাত নিরোধক একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে বলে জানা যায়। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে
সরকারি কর্মচারিদের এধরণের আইনের আওতায় আনার আগে তাঁদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণকারী জনপ্রতিনিধিদের
জন্য কি একইধরণের বিধি-বিধান আবশ্যক নয়?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন