বৃহস্পতিবার ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঢাকার এক বন্ধু আমাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের
একটি চিঠির কপি পাঠিয়েছেন। চিঠির বিষয়বস্তু তখনও ঢাকার কোনো গণমাধ্যমে খবর হিসাবে আসেনি।
খবরটি হচ্ছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত বিষয়ে প্রচারণা/ গুজব মনিটরিং করার জন্য
১৫ জন উপ ও সহকারী সচিব এবং একজন সিস্টেম অ্যানালিস্টকে দেশের ৩০টি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের
দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিটি থেকে জানা গেল যে মন্ত্রণালয়ের করোনা
প্রতিরোধকরণে প্রচার প্রচারণা সংক্রান্ত কমিটি গত ২৪ মার্চ বৈঠক করে যেসব সিদ্ধান্ত
নিয়েছে, তার আলোকেই এসব দায়িত্ব বন্টন। মনিটরিংয়ে গুজব চিহ্নিত হলে তা বন্ধ করার জন্য
মন্ত্রণালয়ে জানানোর যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল, স্বভাবতই তা সাংবাদিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য
তৈরি করে। দিন পেরোনোর আগেই বিরুপ প্রতিক্রিয়ার মুখে চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
তবে, নজরদারির জন্য একটি সেল যে থাকছে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। যেসব চ্যানেলের ওপর নজরদারির
সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেগুলোর প্রায় সবই সরকারঘনিষ্ঠ।
সরকারসমর্থক চ্যানেলগুলোর ওপর নজরদারির উদ্যোগ প্রত্যাহারের প্রকাশ্য
ঘোষণা যদি একটি নিরীহ ভুল শুধরে নেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই
সাধুবাদ জানাতে হবে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, অঘোষিত নজরদারি এবং খবরদারি বন্ধ হবে কি?
সেল থাকার ঘোষণা তা বলে না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই যেভাবে ভয় পায়, আমরাও সেরকম
শংকিত। বিশেষ করে অভিজ্ঞতা যেখানে মোটেও সুখকর নয়।
জনস্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি আলাদা হলেও এখানে সাম্প্রতিক অতীতের
সংকটগুলোর দিকে ফিরে তাকানো মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ছাত্রদের কোটাসংস্কারের দাবি,
সড়কে নিরাপত্তার আন্দোলন এবং নির্বাচনগুলোর সময়ে সরকার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ভূমিকা এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন। সরকারী ভাষ্য ও ভাবাদর্শের
বিরোধী ভাষ্য প্রচারের নানাধরণের দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য বাধা সৃষ্টির নতুন নতুন নজির
তৈরি হয়েছে। বিরোধী রাজনীতিক এবং ভিন্নমতের অনুসারীদের চরিত্রহননকারী ভিত্তিহীন অভিযোগ
ফলাও করে প্রচারকে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীনদের ত্রুটি-বিচ্যূতি তুলে
ধরা হলে সেগুলোকে বিএনপি-জামাতের অপপ্রচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু, ছাত্র আন্দোলন
দমনের লক্ষ্যে এবং নির্বাচনের দূর্নীতি ও অনিয়ম অস্বীকার বা আড়াল করতে সেগুলোকে গুজব
বলে অভিহিত করা হয়েছে। ছাত্রবিক্ষোভের খবর ও বিশ্লেষণকে গুজব অভিহিত করে আলোকচিত্রী
শহীদুল আলমকে গ্রেফতারের কথা দেশের বাইরেও বিপুলভাবে আলোচিত। সোজা কথায়, গুজব বা অপপ্রচারকে
কখন খবর বলা হবে , আর খবরকে কখন গুজব অভিহিত করতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া সরকারের একটি
পুরোনো চর্চা।
মহামারির কালে সরকার যদি একই চর্চা বহাল রাখেন, তাহলে কী হতে পারে
তা বোঝার জন্য কারো খুব বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। করোনা মোকাবেলায় আমাদের বিশ্বমানের
প্রস্তুতির কথা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা কতবার শুনেছি তার হিসাব দিতে হলে সম্ভবত
নতুন করে অংক শিখতে হবে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে
২৪ মার্চ পর্যন্ত সরকারের কোনো পর্যায় থেকেই কেউ সংক্রমণ মোকাবেলার পরিকল্পনা সম্পর্কে
সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেন নি, বা চান নি। ২৫ শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে
দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেই প্রথম জানা গেল দেশে করোনা শনাক্তকরণ সরঞ্জামের মজুত কত,
কটি গবেষণাগারে পরীক্ষা চালানো সম্ভব, হাসপাতালে মোট কত শয্যা পাওয়া যাবে ইত্যাদি।
এসব
তথ্য থেকে আমরা আমাদের সামর্থ্য কতটুকু সেবিষয়ে কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। ব্যাক্তিগতভাবে
সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণের জন্য এই ধারণা পাওয়াটা খুবই জরুরি। কিন্তু, দেশে সরকারঘোষিত
বনধ্ বা লকডাউন ঘোষণার পর এখন কি আর ব্যাক্তিগতভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সুযোগ আছে?
দেশে সংক্রমণ ও নিহতের যে পরিসংখ্যান গত দুসপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে
সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হচ্ছে, তাতে মানুষের মনে প্রশ্ন - কম সংক্রমণের রহস্য কি
কম পরীক্ষা? পরীক্ষা না হলে রোগ ধরা পড়ার কোনো কারণ নেই। দশ দিনের গণছুটিতে যে লাখ
লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেছেন তাঁদেরকে কি পরীক্ষার বাইরেই রাখা হবে? সংক্রমণ দমনে সম্মুখসারিতে
কি পেশাদার স্বাস্থ্যসেবীরা? নাকি, আমলারা? নাহলে ব্যাক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, পিপিই
চিকিৎসাসেবীদের কাছে পৌঁছানোর আগে আমলারা সেগুলো পরে ছবি তুলছেন কেন? এসব প্রশ্নের
উত্তর অবশ্য আইই্ডিসিআর এর সংবাদ সম্মেলনকারীর জানার কথা নয়।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিদেশী টিভির কল্যাণে একথা এখন অনেকেই জানেন
যে করোনারোগীদের অধিকাংশেরই সুস্থ হওয়ার কথা হলেও যথাযথ চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুর দিকেই
পাল্লা ঝুঁকবে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চিকিৎসাসেবীরা নিজেরা নিরাপদ না হলে তাঁরা
যেমন ঝুঁকিতে পড়বেন, তেমনই রোগীরও ঝুঁকি বাড়বে। করোনা আক্রান্ত কারো হাসপাতালের চিকিৎসা
প্রয়োজন হলে ভেন্টিলেটর এবং নিবিড় পরিচর্যা বা আইসিইউ জীবন বাঁচানোর জন্য খুবই জরুরি।
অথচ, দেশে আইসিইউর সংখ্যা কত তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
করোনা দমনের নীতিকৌশল এবং তথ্য নিয়ে লুকোচুরি হচ্ছে বলে অনেকেই সন্দেহ
প্রকাশ করে আসছিলেন। ২৫ মার্চ একই দিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি এবং বাতিল করা দুটি
সিদ্ধান্ত সেই সন্দেহকে যে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। মহামারি মোকাবেলায় বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা যে বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, তা হলো নাগরিকদের
সক্রিয় অংশগ্রহণ। ভয় দেখিয়ে এবং ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে সহজ কাজটি বরং কঠিন হয়ে যায়।
নাগরিকদের স্বেচ্ছায় সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন সচ্ছ্বতা এবং
অবাধ তথ্যপ্রবাহ। জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড
কের ভাষায় মানুষের স্বাস্থ্য শুধু স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতার ওপরই নির্ভরশীল নয়। স্বাস্থ্য
ঝুঁকির যথাযথ প্রকৃতি এবং তা থেকে নিজের, পরিবারের এবং জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার উপায় সম্পর্কিত
সঠিক তথ্যের ওপরও তা নির্ভরশীল। কোভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারির পটভূমিতে গত ১৯ মার্চ ডেভিড
কে ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা, ওএসসিই এবং ইন্টার অ্যামেরিকান কমিশন ফর হিউম্যান
রাইটস এক যৌথ বিবৃতিতে সরকারগুলোর প্রতি সংক্রমণের
ঝুঁকির বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানান। আতঙ্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে
গুজব এবং অপপ্রচারের ঝুঁকি মোকাবেলায় শুরু থেকেই নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রকাশের ওপর বিবৃতিতে
জোর দেওয়া হয়। ওই বিবৃতিতে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সহযোগিতা দেওয়ার কথাও
বলা হয়।
এই বৈশ্বিক মহামারি গণমাধ্যমের জন্যও এক নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে।
সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে চরম ঝুঁকির্পূণ পরিস্থিতিতে গ্রাহকের
কাছে যথাযথ এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্র - তথ্য, পটভূমি এবং সম্ভাব্য সব বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ
পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রাম করছেন। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সংকটের কালে মানুষের তথ্য পেতে
ব্যকুল হয়ে পড়ে। তাকে আর তখন শুধু আগ্রহ হিসাবে গণ্য করা যায় না। অথচ, এই সংকটকালেই
মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রতি নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। কোনোধরণের
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই খবরের কাগজকে ভাইরাসের বাহক হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে। মহামারির
অনুসঙ্গ হিসাবে যে সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে তাতে এমনিতেই গণমাধ্যম
অনেক বড় এক সংকটে পড়তে পারে। এই পটভূমিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অধিকার সুরক্ষার
লড়াইটাও কম গুরুত্বর্পূণ নয়।
(২৭ মার্চ ২০২০ প্রথম
আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন