মহামারির
সঙ্গে স্বাভাবিক সময়ের তুলনা চলে না। বিশেষ করে, যে মহামারিতে শত্রু অদৃশ্য রোগটা
অতিছোঁয়াচে এবং মৃত্যুঝুঁকি হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। আমাদের আইনে মহামারির সময়ে সংক্রমণ
ঝুঁকির তথ্য গোপন নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে, আইনে সরকারি কর্মচারি
এবং সাধারণ নাগরিকের মধ্যে কোনো পার্থক্যও করা হয়নি। অথচ, এখন সেই তথ্য আড়ালের প্রাণান্তকর
চেষ্টারই প্রতিফলন ঘটছে।
ফেসবুকসহ
অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি সম্পর্কে বিরুপ
মন্তব্য সংবলিত কোনো পোস্ট দেওয়া ও সে ধরণের পোস্টে লাইক বা শেয়ার করা থেকে সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরত থাকার এক নোটিশ জারি করা হয়েছে গত ৭মে। কেউ তা না মানলে
আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই নোটিশটি জারি করা হলো এমন দিনে,
যেদিনে ফেসবুকে সরকার অথবা কোনো ব্যাক্তিবিশেষ বা তাদের কাজের সমালোচনা এবং ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে
একদিনে ঢাকায় ১১ জন এবং অন্যান্য জায়গায় আরও অন্তত ৪ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল
নিরাপত্তার আইনে মামলার বিষয়টি শহরে সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছিলো। এসব আলোচনা
বেশিরভাগই সামাজিক মাধ্যমে, কিছুটা টেলিফোনে আর কিছুটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
মামলা দেওয়ার আগে কোনোধরণের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া লেখক, কার্টুনিস্ট,
ব্যবসায়ীসহ কয়েকজনকে সাদা পোশাকের লোকজন বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অনেকের মধ্যে
গুমের আতঙ্কও দেখা দেয়। যদিও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে
হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে।
টেলিভিশনের
কথিত ব্রেকিং নিউজের স্ক্রল এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংবাদভিত্তিক অনলাইন পোর্টালগুলোতেও
এই হুঁশিয়ারির কথা প্রচার হতে থাকে। কিন্তু, হুঁশিয়ারিটি যে শুধু সরকারি কর্মচারিদের
জন্য প্রযোজ্য সেটা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়। হয়তো উদ্দেশ্যটাই এমন ছিল। লকডাউনে
থাকা সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত যখন করোনার চিকিৎসার অব্যবস্থা, সংক্রমণ
নিয়ন্ত্রণের বেহাল দশা এবং বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অস্থিরতায় ভুগছেন, তখন ফেসবুকে
সরকারের সমালোচনা-নিন্দা-প্রতিবাদ স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে। সুতরাং, পরিস্থিতি সামাল
দেওয়ার লক্ষ্যে এধরণের হুশিয়ারি মোক্ষম বলে বিবেচিত হয়ে থাকতে পারে। তা নাহলে,
সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এরকম নির্দেশনা জারি করতে হবে কেন?
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের
চাকরিবিধিতে অনেকধরণের বিধিনিষেধ আছে। তাঁরা সাধারণত: সরকারবিরোধী মতামত এড়িয়ে
চলেন। তাছাড়া, ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়ে ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদ প্রজ্ঞাপন
জারি করে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল। পরে, তা
আবার হালনাগাদও করা হয়েছে। তবে, যথারীতি সরকারের বাইরেও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে
এঁদের অনেকে নানাসময়ে মন্তব্য করলেও কখনো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে
শুনিনি। সরকারবিরোধী কোনো মতামত তাঁরা কখনও করেছেন এমনটি চোখে পড়েনি। বিরল এরকম
কিছু হলে তা এতো ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার কথা যে সেধরণের কিছু গণমাধ্যমের চোখের
আড়ালে থাকতো না।
তাহলে, হঠাৎ
কেন সরকার আবারও এই হূঁশিয়ারির কথা স্মরণ করানো জরুরি মনে করলো ? এর সম্ভাব্য
ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে একটি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। গণ সমালেচনা বন্ধের জন্য
জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টির কৌশল হিসাবে এটি বেশ কার্যকর হতে পারে। অন্য আর যে
সম্ভাবনাগুলো থাকে তা হচ্ছে : চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের মুখ বন্ধ করা, যাঁদের ক্ষেত্রে
সরকারি চাকরিবিধির কড়াকড়ি প্রয়োগ তেমন একটা ছিল না। বিশেষত: ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক
দলের অনুসারী চিকিৎসকরা রাজনৈতিক কর্মীর মত আচার-আচরণ করলেও অতীতে তা কখনোই
শৃঙ্খলাবিধির ব্যত্যয় হিসাবে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পিপিই এবং এন নাইন্টিফাইভ মাস্ক নিয়ে যে অবিশ্বাস্য
কেলেংকারি ঘটেছে, তার খেসারত যেহেতু চিকিৎসকদের জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে, সেকারণে তাঁদের
ক্ষোভের বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। এবিষয়ে যথাযথ সরকারি
বিধি মেনে যাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁদের পরিণতি কী
ঘটেছে, তা আমরা সবাই জানি। অথচ, দেশের প্রচলিত জনস্বার্থ
সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা প্রদান আইন ২০১১‘য় তাঁদের সুরক্ষা পাওয়ার কথা। অতএব, এই
হুঁশিয়ারি চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসেবীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বন্ধের চেষ্টায় হয়ে
থাকতে পারে ।
তাছাড়া, রোগের
বিস্তৃতি বাড়তে থাকা এবং হাসপাতালগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে অন্যান্য সরকারি কর্মচারিদের
মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে
সরকার তাঁদেরও সাবধান করতে চাইছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
বলে রাখা ভালো,
আগেকার নির্দেশনাগুলো থেকে নতুন পরিপত্রের একটা পার্থক্য আছে। তাহোল, এবারই আলাদা
করে কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বর্পূণ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে বিরুপ মন্তব্যের কথা বলা হয়েছে।
যদিও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বর্পূণ ব্যাক্তির আইনগত সংজ্ঞা কী, বা কোন আইনে আছে তার কোনো
উল্লেখ পরিপত্রে নেই। দেশে খুব গুরুত্বর্পূণ ব্যাক্তি বা ভিআইপি এবং ভিভিআইপিদের
জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কারা ভিআইপি তা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে। আর
প্রচলিত ভিআইপিমাত্রই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বর্পূণ ব্যাক্তি হবেন বিষয়টি এমন হওয়ার কথা
নয়। অন্যান্য নির্দেশনার মধ্যে জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো লেখা, অডিও বা ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ বা শেয়ার
করা যাবে না বলেও এতে বলা হয়েছে। পরিপত্রের এই নির্দেশনাতেই সরকারের আসল উদ্দেশ্য
প্রতিফলিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হলে, তা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না।
সরকারি
চাকরিবিধির বাইরে আলাদা করে এধরণের নির্দেশনা স্বাভাবিক সময়ে জারি করা হলেও তা
নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। এখন মহামারির অস্বাভাবিক সময়ে তাই এমন নির্দেশনা জারিকে
কোনোভাবেই স্বাভাবিক হিসাবে গণ্য করা যাচ্ছে না। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮‘য় বরং জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি
করে এমন তথ্য গোপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই আইনের ২৪ এর ১ উপধারায় বলা হচ্ছে : যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা
বিস্তার ঘটিতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত
ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট
গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধির
অধীনেই এই অপরাধের তদন্ত ও বিচার হওয়ার কথা বলা আছে আইনে। খুনের অপরাধে যেমন
সরকারি কর্মকর্তা আর সাধারণ নাগরিককে আলাদা করা দেখা হয় না, এক্ষেত্রেও তেমনই
হওয়ার কথা। সুতরাং, চিকিৎসক, নার্স, আয়া, শুচিকর্মী কিম্বা প্রশাসক সবারই সংক্রমণ
ঝুঁকির বিষয়ে তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব আছে। জনস্বাস্থ্যের তথ্য শুধু উর্ধ্বতন কর্তাকেই
জানানোর বিষয় নয়, ঝুঁকিতে থাকা সবাইকে জানানোর বিষয়। আর, সেক্ষেত্রে, সোশ্যাল মিডিয়ায়
নিম্নমানের পিপিই, মাস্ক কিম্বা অন্য যেকোনো সংক্রমণ ঝুঁকির বিষয়ে সহকর্মী, পরিবার
এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সজাগ করার মত তথ্য ও মতামত প্রকাশ নিষিদ্ধ হবে কেন?
আবার এই আইনেই আরেকটি ধারা, ২৬ (১) বলছে: যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ
সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান
করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। তথ্য প্রদানের
ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত যেধরণের লুকোচুরিতে অভ্যস্ত
হয়ে উঠছেন, তাতে প্রশ্ন তোলাই যায় যে, তাঁরা আইন লংঘন করছেন কিনা?
(৯মে, ২০২০‘র প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন