বৈশ্বিক মহামারির
ছোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানার প্রায় ১১ সপ্তাহ পর একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসক বলেছেন দেশে করোনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। গত ২৪ মে কোভিড–১৯ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে একথা জানিয়েছেন। ব্যক্তিগত
গাড়ি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন ‘ঘোষণাটি সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক হয়েছে’। ‘সরকারের কথা ও
কাজের মধ্যে মিল থাকছে না’ বলেও তিনি মন্তব্য
করেছেন। তাঁর মতে ‘আগামী ৫ থেকে
৭ দিনের মধ্যে দেশে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।’ প্রয়োজনে
সরকারকে কার্ফু দিতে হবে হবে বলেও মনে করছেন তিনি। অন্য কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে
ভাইরোলোজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং এপিডেমিওলজিস্ট অধ্যাপক শহীদুল্লাহও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে
একইধরণের আশংকার কথা জানিয়েছেন। তবে, কার্ফু জারির মত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সীমিত
আকারে গণপরিবহন চালুসহ অর্থনীতি সচল করার দিনতারিখ ঘোষণা হয়েছে বুধবার।
সংক্রমণের
বিস্তার ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞদের এসব মূল্যায়ন ও আশংকা বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার নির্দেশনার অনুরুপ। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও একইরকম। যেখানেই কড়াকড়িভাবে লকডাউন
কার্যকর হয়েছে, সেখানেই মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়েছে, দেশগুলোর
চিকিৎসাব্যবস্থা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম
হয়েছে। যেসব দেশ শুরুতে বিপদ কতটা গুরুতর তা বুঝতে পারেনি, কিন্তু দ্রুত কড়াকড়ি
লকডাউনের পথে গেছে, তাদের মূল্য দিতে হয়েছে অনেক বেশি। ইতালি আর স্পেন এক্ষেত্রে
বড় উদাহরণ। ব্রিটেন শুরুতে ভুল পথে হাঁটায় তার মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপের শীর্ষে এবং
এখনও বাড়ছে। এরইমধ্যে, সানডে টাইমস গত ২৩ মে বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্লেষণ করে
দেখিয়েছে সেখানে লকডাউন কার্যকর করতে মাত্র
নয় দিন দেরি করায় সংক্রমিতের সংখ্যা দুই লাখের বদলে পনেরো লাখে পেীঁছাত। মৃত্যুর
সংখ্যা অন্তত ৩৬ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণও সেটাই। এখন লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসতে
সময় বেশি লাগার কারণও এটি।
এই
বৈশ্বিক মহামারিতে অবশ্য সব পরিসংখ্যানের শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যুর সংখ্যা
এক লাখে ছাড়িয়েছে। আর, সংক্রমিতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সতেরো লাখ। দেশটির চিকিৎসা
বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক মতামত একরকম, আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরেকরকম। তাঁর কাছে
অগ্রাধিকার হচ্ছে অর্থনীতি সচল করা। রাজনৈতিক কারণে ধর্মচর্চার সুযোগ দেওয়াও তাঁর
জন্য বিশেষভাবে জরুরি। ফলে, সংক্রমণ বাড়ার হুঁশিয়ারি তাঁর কাছে বিচার্য্য নয়। তাঁর
দল রিপাবলিকান পার্টি যেসব রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেই সব রাজ্যেও তাঁর ইচ্ছারই
প্রতিফলন ঘটছে।
আমাদের
দেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কেউ কেউ দেশের অগ্রযাত্রা ও উন্নয়নের কথা তুলে ধরতে
প্রায়শই যুক্তরাষ্ট্রের দুই-একটি শহরের কথা বলেন। আলোঝলমলে ঢাকাকে আকাশ থেকে দেখতে
তাঁদের কাছে লসএঞ্জেলস মনে হয়। মহামারি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিন্তু এখন এই
সাদৃশ্যটা সত্যি সত্যিই দেখা যাচ্ছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ কৌশলে বিজ্ঞানকে যে পিছনে ঠেলে
দেওয়া হয়েছে তা মোটামুটি পরিষ্কার। পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে টানাহেঁচড়া এবং সীমিত
পরিসরে ঈদের বাজার খুলে দেওয়ার সময়েও বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে এগুলোর কারণে মহামারির স্থায়ীত্ব দীর্ঘায়িত
হবে। তাঁদের সেই আশংকা যে অমূলক ছিল না, তা প্রমাণিত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণযোগ্য সীমিত
সংক্রমণ সামাজিক সংক্রমণের রুপ পেয়েছে এবং অল্প কিছু এলাকায় সীমিত না থেকে তা সারাদেশে
ছড়িয়েছে। এই বিপদ যে এখন আরও দীর্ঘায়িত হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত।
অফিস-আদালত,
কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গণপরিবহনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনাও
তৈরি হয়েছে এবং সেগুলো সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে, স্বাস্থ্যবিধিগুলো
কার্যকর করা সহজ নয়। এরজন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। নির্দেশনাগুলো মানতে হলে
অফিসগুলোকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হবে। যানবাহনগুলোতে আসনবিন্যাস বদলাতে হবে। কারখানাগুলোর
যন্ত্রপাতির বিন্যাস যেভাবে আছে সেভাবে তা চালু হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে
চলার সুযোগ কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্রের
সাম্প্রতিক গতিধারা দেখে মনে হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা যাই হোক না কেন দেশটি পুরো
জনগোষ্ঠীকে সংক্রমণের বিপদ মোকাবেলার মুখে ঠেলে দেওয়ার পথেই অগ্রসর হচ্ছে। যাঁদের
রোগপ্রতিরোধীক্ষমতা আছে তাঁরা টিকে যাবেন, আর টিকবেন তাঁরা - যাঁরা চিকিৎসার সুযোগ
পাবেন। সেখানে করোনা রোগে মৃত্যুর সারিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল
মানুষেরা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের লাশের সারি দীর্ঘ হবে। ভারত এবং ব্রাজিলেও একই
নীতি অনুসরণের আলামত মিলছে। প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি যুক্তরাষ্ট্রকেই অনুসরণ করছি?
(২৮ মে, ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন