সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গ্যাস বিস্ফোরণে মৃত্যুর বিচার কোন আইনে

 

মা, টিভি বন্ধ কোরো না বলে সাত বছরের যে শিশুটি বাবার সঙ্গে বাড়ির কাছের মসজিদে গিয়েছিল সেই জুবায়ের তার মার কাছে আর ফেরেনি। নারায়ণগঞ্জের মসজিদের মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডে অন্য আরও অন্তত ৩১ জনের সঙ্গে তারও মৃত্যু হয়েছে। মসজিদের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের কারণ নির্ধারণে একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে। হয়তো আরও হবে। কিন্তু, একটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট যে গ্যাস লাইনে ছিদ্র থাকার কারণে বেশ কয়েকদিন ধরেই সেখানে বাতাস দাহ্য হয়ে পড়েছিল। গ্যাস কোম্পানির কয়েকজন মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী ও কর্মী বরখাস্ত হয়েছেন। তবে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ত্রুটির জন্য দায়ী বড়কর্তাদের কিছু হয়নি। যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি চলে, তাঁরাও কেউ কোনো দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায় নি।  দমকল বাহিনীর কর্মকর্তারা, মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয় লোকজন সবাই এই অভিন্ন কারণটির কথা বলেছেন।

গ্যাস সরবরাহের এই লাইনটি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্ব যে কোম্পানির, সেই তিতাসের আঞ্চলিক কর্মকর্তা অবশ্য তা স্বীকার করেন নি। বরং, বলেছেন তাঁদের কাছে কেউ এমন অভিযোগ করে নি। আর, কোম্পানির প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টি তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশেল অধিকাংশ আইন যে দেশটির নজির অনুসরণে প্রণীত, সেই ব্রিটেনে এধরণের ঘটনায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আলাদা আইনে খুন তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় এমন অভিযোগে মামলা হতো। বাংলাদেশে অবশ্য এধরণের কোনো আইন নেই। এধরণের আইন অন্য অনেক দেশেই আছে। দায়িত্বে অবহেলা কিম্বা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সাবধানতা অনুসরণ না করার কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে সেই মৃত্যুর জন্য যে বা যারা দায়ী তাদের বিচারই হলো এই আইনের উদ্দেশ্য। করপোরেট ম্যানস্লটারের ক্ষেত্রে ব্যাক্তির জায়গায় কোম্পানিকেও একটি স্ত্ত্বা হিসাবে গণ্য করা হয়। গ্যাস, বিদ্যূত, পানি সরবরাহের মত পরিষেবা দেওয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর জন্যও গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের জন্যও আলাদা যুতসই কোনো আইন নেই। 

কর্তৃপক্ষীয় অবহেলার জন্য চারবছরের শিশু জেহাদের মৃত্যুর কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ঢাকার শাহজাহানপুরে রেলওয়ের মাঠে একটি পরিত্যক্ত পানির পাইপে পড়ে গিয়ে জেহাদের মৃত্যু হয়েছিল। পানির পাইপের মুখটি খোলা থাকার কারণে রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জিহাদের বাবা মামলা করলে সেই মামলায় বিশেষ জজের আদালত রেলের তিনজন এবং একজন ঠিকাদারের দশ বছর করে কারাদ্ন্ড এবং দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। কিন্তু, হাইকোর্টে সেই রায় নাকচ হয়ে যায় এবং সবাই খালাস পেয়ে যান।

হাইকোর্টে রায় খারিজ হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় রেলওয়ে ম্যানুয়ালে ওই পরিত্যক্ত পাইপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দন্ডিত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের নয়। তাদের যে আইনে সাজা দেওয়া হয়েছিল সেটিও ঠিক ছিল না বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ে ঘটনাটিকে অবহেলাজনিত হত্যা নয়, বরং দুর্ঘটনা হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়। দেশে এধরণের প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার সুর্নিদিষ্ট আইন কতটা প্রয়োজন ও জরুরি, এই মামলাটি তার একটি দূর্ভাগ্যজনক প্রতীক। 

অবশ্য, এর আগের আরও একাধিক দৃষ্টান্ত আছে, যেগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির কাউকেই কোনো জবাবদিহি করতে হয় নি। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনাটি হয়তো আমরা অনেকেই বিস্মৃত হয়েছি। ঢাকার বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটিপূর্ণ কাজের ফলশ্রুতিতে সেখানকার একটি ছয় তলা ভবন সিলভারস্টোন স্যাফায়ার এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তা বসবাসের অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল। ভবন মালিকের ছেলে দগ্ধ হন এবং আহত হন ছয়জন। ভবন মালিক তিতাস কর্তৃপক্ষকে তিনবার গ্যাসলাইন থেকে গ্যাস বেরুনোর কথা জানালেও কোনো কাজ হয়নি। কয়েকদিন পর সরকার তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় বলে সংবাদপত্রগুলোতে খবর বের হয়। তবে, অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। বনানীর সঙ্গে তো আর সব এলাকার তুলনা চলে না।

ওই বছরেরই ১১ এপ্রিল প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায় শেওড়াপাড়া এলাকায় রাত তিনটার সময়ে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে আগুন লাগার খবর জানানোর পর তিতাস গ্যাসের কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেছিলেন, মানুষ তো আর আগুনে পুড়ে মরেনি। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। এর আগে, সে বছরেই ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরায় গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের চার সদস্য মারা যান। গত কয়েকবছরের সংবাদপত্রগুলো খুঁজলে এরকম আরও অনেক ঘটনার খবর মিলবে।

অধিকাংশক্ষেত্রেই দায়িত্বহীনতার পরিণতিতে অবহেলাজনিত হত্যা ও জখমের ঘটনা ঘটলেও খবরে তা আসে দূর্ঘটনা হিসাবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতেও কখনো কখনো আইনগত প্রতিকার চাওয়ার কেউ থাকে না। যদি কেই থাকেনও তাহলে দেখা যায় মামলা করার পর তদবিরের অভাবে বছরের পর বছর সেগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় থেকে যায়। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এধরণের মামলার বিচারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি শিশু জিহাদের মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলোর অসহায়ত্বের অবসানে তাই এমন আইনগত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা সহজেই বিচার এবং ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।       

মসজিদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেন এবং কতটা প্রয়োজন অথবা তা গ্যাস পাইপলাইনের ওপর বৈধভাবে না বেআইনীভাবে নির্মিত হয়েছে এধরণের অনেক প্রশ্নই এখন উঠছে। তবে, অপ্রাসঙ্গিক কিম্বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিতর্কের জন্ম দিয়ে অনেকেই অত্যন্ত গুরুতর দায়িত্বহীনতার বিষয়টিকে আড়াল করে ফেলছেন বা গুরুত্বহীন করে তুলছেন। সব বেআইনী কাজের মূলে হচ্ছে প্রশাসনের জবাবদিহিতার অভাব। মসজিদটি যদি বেআইনীভাবে নির্মিত হয়েও থাকে, তাহলে তার দায়ও প্রশাসনের ওপরেই বর্তায়। যে কোনো স্থাপনা নির্মাণে সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ও সহায়তা প্রয়োজন হয়। অনিয়ম অথবা আইন লংঘন হয়ে থাকলে সেটি প্রতিকারের ব্যর্থতা কার ?

বছর বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময়ে সেবার মান উন্নয়নের প্রশ্নটিকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রমাণ মেলে না। অথচ, তার পরিণতি হচ্ছে বেশি দামে বেশি মৃত্যু কেনা। নারায়ণগঞ্জে এই মসজিদটির ক্ষেত্রে সরকারী এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার পরিণতি হচ্ছে ২৭ জনের প্রাণহানি। নিশ্চিত অবহেলার কারণেই এসব মৃত্যু ঘটেছে। এই অবহেলা অপরাধ তো বটেই, এর অন্য আরেকটি দিক হচ্ছে নিহতদের পরিবারগুলোর ক্ষতির প্রশ্ন। এসব পরিবারের কেউ হারিয়েছেন একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে, কেউ হারিয়েছেন অনিরপণীয় সম্ভাবনাময় তরুণ সন্তানকে। কিন্তু, তাঁদের ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়াও অস্পষ্ট ও জটিল।  বাংলাদেশ গ্যাস আইন ২০১০ এবং তিতাসের গ্যাস সংযোগ নীতিমালায় গ্রাহকদের জরিমানাসহ নানাধরণের সাজার কথা আছে। কিন্তু, দুটর কোনোটিতেই গ্রাহকের ক্ষতিপূরণে কোম্পানির দায়-দায়িত্বের বিষয়ে একটি শব্দও নেই। অর্থাৎ, অপরাধ হিসাবে ফৌজদারি বিচার কিম্বা ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানী বিচার কোনোটিরই কোনো পথ খোলা নেই। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। অবহেলাজনিত মৃত্যু বা হত্যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দায় নির্ধারণে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি উভয় ধরণের আইন তৈরি ও তা কার্যকরের প্রসঙ্গটিকেই এখন অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

(১৩ সেপ্টেম্বর,২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...