আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটকে জানিয়েছেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধের জন্য তাঁর সরকার একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। জেনেভায় হাইকমিশনারের দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি বিষয়ে একথা জানান (‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে’, ইত্তেফাক অনলাইন, ২৬ মার্চ, ২০২২)। খবরে বলা হয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক সভায় অংশ নিতে জেনেভায় অবস্থানকালে আইনমন্ত্রী জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের সঙ্গে দেখা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে সরকারের গৃহীত কার্যক্রমসমূহ তাঁর কাছে তুলে ধরেন। তিনি হাইকমিশনারকে জানান যে সরকার ইতিমধ্যে একটি টেকনিকাল কমিটি গঠন করেছে এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করছে।
আইনমন্ত্রীর এ বৈঠকের বিষয়ে অবশ্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে কোনো বিবরণ প্রকাশ করা হয় নি। নানা কারণে এ বৈঠক মানবাধিকার সংগঠকদের কিছুটা কৌতুহলী করে তুলেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও মানবাধিকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার যখন দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি, তখন এই কৌতুহল খুবই স্বাভাবিক। ১৪ মার্চ জাতিসংঘের ১৬ জন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এক যুক্ত বিবৃতিতে মানবাধিকারকর্মী ও গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বন্ধের আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তাঁরা অভিযোগ করেন গত বছরের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্য ও মানবাধিকারকর্মীদের হুমকি দেওয়া ও হয়রানি করা হচ্ছে।
এর আগে ৩ মার্চ জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি, সিএটি বা ক্যাট জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিকে একটি চিঠি দিয়ে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য না জানানোয় তাঁর সঙ্গে অথবা সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে একটি বৈঠকের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের আগস্টে কমিটির পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা রাষ্ট্রপক্ষকে জানিয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি একবছর পর জানানোর কথা বলা হয়েছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কমিটির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় জানিয়ে সর্বসাম্প্রতিক এ চিঠিতে বলা হয় যে সুপারিশগুলো জানানোর পর দুই বছরেও কোনো সাড়া মেলেনি। ক্যাটের চিঠিতেও যেসব নাগরিক ( মানবাধিকার) সংগঠন কমিটিকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে, তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া বা হয়রানি না করার সুপারিশটির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্য অনুষ্ঠিত সংলাপ উপলক্ষে সফরের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডও কূটনৈতিক ভাষায় তাঁদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থনের কথা জানিয়ে গেছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর এক টুইটে তিনি গণতন্ত্র, শ্রমিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর সাহসের প্রশংসা করে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনার কথা জানিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি সরকারের ক্ষোভ ও বিরক্তি নতুন কিছু নয়, বিশেষ করে দেশীয় সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীনভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও অধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর রেকর্ড সংরক্ষণ করে। এসব সংগঠনের বিদেশ থেকে তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। নানা ধরনের প্রশাসনিক বাধা, নজরদারি ও হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। এধরণের পদক্ষেপে যে আসলে উল্টো ফল হতে পারে, সে কথা আমাদের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ভুলে গেছেন। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের এসব বিবৃতি যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পর্যালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চয়ই সরকারের কর্তাব্যাক্তিদের জানা আছে। আইনমন্ত্রী এসব বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বা স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ নিরসনে কতটা সফল হয়েছেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে যেটুকু বোঝা যায় তা হচ্ছে, শুধু আশ্বাস বা মুখের কথায় কোনো কাজ হবে না। জাতিসংঘ সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবায়নের পদক্ষেপ দৃশ্যমান হতে হবে।
মন্ত্রীদের কথা এবং কাজে অবশ্য যে ধরনের অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। উদাহরণ হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যের কথা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্র যাতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, সে জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন কিনা - প্রথম আলোর এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, আমরা একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই গত তিন মাসে একজনও র্যাবের কারণে মারা যায়নি। পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। র্যাবের জবাবদিহি নিশ্চিতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে, তা জানতে চাইলে এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, `র্যাবের কোনো কোনো সদস্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে শাস্তির মুখে পড়েছেন। নানা ধরনের অভিযোগে অন্তত ২৭০ জন অফিসারের পদাবনতি হয়েছে। চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। একটি মামলায় ফাঁসিসহ র্যাব সদস্যদের নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।`
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় মনে হয়, সরকার সমস্যাটি স্বীকার করে নিয়ে তা দূর করার নির্দেশ দেওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, আর বিচারবহির্ভূত হত্যার অপরাধ ঘটছে না। র্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির কারণে কতজনের পদাবনতির মতো সাজা হয়েছে, তার বিবরণেও মনে হয় জবাবদিহিতার পদক্ষেপের কারণে তারা সংযত হয়েছে। গুমের বিষয়েও প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, `গুম তো হয়েছে, কিন্তু এঁদের মধ্যে সাতজন তো বের হয়ে আসছেন`।
সরকারের পক্ষ থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অবশ্য গুমের বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। বরং, গুমের অভিযোগগুলোকে নিখোঁজ বা অন্তর্ধান এবং অপরাধী চক্রের অপহরণের মত সমস্যা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। `এনফোর্সড` শব্দটি সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়ে শুধু `ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স`, মিসিং ও কিডন্যাপিং শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। ফিরে আসা সাতজনের নাম-পরিচয় দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে তাঁদের গুম হওয়ার অভিযোগ ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যে সাতজন ফিরে এসেছেন, তাঁদের কয়েকদিন থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত কোনো খবর ছিল না। তাঁরা কেউই আত্মগোপন করেননি। যদি তাঁরা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বাইরে অন্য কারো দ্বারা অপহৃত হয়ে থাকেন, তাহলে সেই অপহরণকারী কারা, কেন তাঁদের দীর্ঘ সময় জোর করে অজ্ঞাতবাসে আটক রাখা হয়েছিল, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কেন? সব নাগরিকের নিরাপত্তাবিধানের যে দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে, তার নিরিখেই এসব অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কেন হয়নি? জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটি যে তালিকা দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য স্বচ্ছ্ব ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের কোনো ব্যবস্থা কেন এখনও নেওয়া হচ্ছে না?
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুলের বিচারবহির্ভূত হত্যার যে ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়েও সরকারের জবাব বিষ্ময়কর। তাঁকে চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ী হিসাবে তুলে ধরে বলা হয়েছে, মাদক উদ্ধারের অভিযানের সময়ে অপরাধী চক্রের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। অথচ মোবাইল ফোনের অডিও রেকর্ড ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। র্যাব প্রতিষ্ঠার পটভূমি যে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, তাদের প্রশিক্ষণ ও মানবাধিকার বিষয়ক নীতিই যে বাহিনীটি অনুসরণ করে - এগুলো মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার দপ্তরের সহযোগিতা নিয়েই সদস্যদের জবাবদিহিতার জন্য ২০১২ সালে ইন্টারনাল এনকোয়ারিস সেল গঠন করা হয়েছে। স্পষ্টতই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দাবি ও সুপারিশ অনুযায়ী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে সরকার মোটেই আগ্রহী নয়।
শুরু করেছিলাম জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানকে আইনমন্ত্রীর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো জানানোর খবরটি দিয়ে। ওই খবরে যে টেকনিক্যাল কমিটির কথা বলা হয়েছে, কিম্বা অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শের কথা রয়েছে, সেখানেও আছে শুভংকরের ফাঁকি। অংশীজনরা চেয়েছেন আইনটি বাতিল অথবা আমূল সংস্কার, কিন্তু মন্ত্রীরা আইনটি প্রয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চান। সাংবাদিকদের বেলায় তদন্তশেষে অভিযোগপত্র দাখিলের আগে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দিয়ে তাঁরা এক আইনের দুই ধরণের প্রয়োগের বৈষম্য তৈরির ব্যবস্থা করছেন। এ ধরণের অভিনব পদক্ষেপ সমস্যার কোনো সমাধান দেবে না, বরং নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দেবে।
(৩১ মার্চ, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন