রাজধানীর তেঁতুলতলা মাঠ এখন পুলিশের কল্যাণে সবার মুখে মুখে। কলাবাগান থানার নিজস্ব ভবন বানানোর জন্য কাজ শুরু করতে গিয়ে পুলিশ যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, তার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদ বেশ সাড়া জাগিয়েছে। একজন নারী ও তাঁর নাবালক পুত্রের সঙ্গে পুলিশ যে আচরণ করেছে, তাকে বেআইনি ও অন্যায় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তেঁতুলতলা মাঠকে খেলার মাঠ দাবি করে আন্দোলন না করার মুচলেকা দেওয়ার পরই মা-ছেলে থানার হাজতখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আন্দোলনের কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, থানার জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজতে বলা হয়েছে এবং তা পাওয়া গেলে সেখানে খেলার মাঠই থাকবে। অবশ্য পুলিশ পাহারায় নির্মাণ কাজ ঠিকই চলছে। এখনও বোঝা যাচ্ছে না আন্দোলন কি সফল হলো, নাকি ব্যর্থ। তারপরও এই নাগরিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার দাবি রাখে।
এই নাগরিক আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি পুরোটাই অরাজনৈতিক। নাগরিক অধিকার রক্ষায় ঢাকায় এর আগে যে আর আন্দোলন হয় নি, তা নয়। কিন্তু অনেক দিন পর এরকম একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন তৈরি হলো। বছর কয়েক আগে ওয়াসার কাছে পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানি চেয়ে একদল ভোক্তা আন্দোলন করলেও তাতে বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছিল না।
গ্যাস ও বিদ্যূতের দাম বাড়ানো নিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হাঁসফাঁস করলেও আন্দোলনের ইস্যু হিসাবে তাতেও খুব একটা আলোড়ন তৈরি হয় না। মূলতঃ বামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিক প্রতিবাদের রীতি অনুশীলন করেছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়েও মাঝেমধ্যে কিছু মানববন্ধন ও প্রতিবাদ হয়েছে বটে, তবে সেগুলোতেও আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা প্রধানত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। বলতে গেলে গত প্রায় এক দশকে মাত্র দুটো আন্দোলন হয়েছে, যার একটি হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন, আর অপরটি ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। রাজনৈতিক আন্দোলন কার্যত একটিও হয় নি।
২০১৩-১৪তে বিএনপি যে নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু করেছিল, তা কিছুটা হটকারিতার কারণে কঠোর দমনপীড়নের মুখে মিলিয়ে যায়। দমননীতির সাফল্যে সরকারের উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠে যায় এবং বস্তুত সেই দমননীতি অব্যাহত থাকায় শুধু বিএনপি নয়, ভিন্নমতের কোনো রাজনৈতিক দলকেই আর মাঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। ডাকসুর সাবেক দুই ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং নুরল হক নুরুর গণ অধিকার পরিষদের কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। একইসময়ে কোনো দলীয় ইস্যু না হলেও রামপাল কয়লাবিদ্যূৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সুন্দরবন রক্ষার জন্য জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা কমিটির আন্দোলনও ওই দমননীতি থেকে বাদ যায় নি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন একধরণের জাতীয় নীরবতা পালিত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গুরুতর নিপীড়ণ, নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের খতিয়ান প্রকাশ করে এসেছে নিয়মিতই। কিন্তু তার বাইরে নাগরিক সংগঠনগুলোর তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। ভিন্নমত দমনে গুম, মিথ্যা মামলার হয়রানি, ক্রসফায়ারের মত ঘটনার যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা একধরণের ভয়ের পরিবেশ তৈরি করায় সাধারণভাবে নীরবতা পালনকেই শ্রেয় বলে গণ্য করা হতে থাকে। সেই নীরবতা ভেঙ্গেছে তেঁতুলবাগানে খেলার মাঠ রক্ষার নাগরিক আন্দোলন। শুধু তা-ই নয় পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতিবাদ না করার মুচলেকা আদায়ের বৈধতার প্রশ্ন তুলে তাঁরা জানতে চেয়েছেন কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না, তার তালিকা দেওয়া হোক। এ প্রশ্নে সবধরণের অন্যায়-অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবাদী হওয়ার আকাঙক্ষারও প্রকাশ ঘটেছে।
খেলার মাঠ রক্ষার দাবিতে যাঁরা প্রতিবাদী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন বিভিন্ন সময়ে সরকারের জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার সুপরিচিত নাগরিক অধিকার সংগঠক, তেমনি আছেন সরকারসমর্থক হিসাবে পরিচিত ব্যাক্তিরাও। যদিও দ্বিতীয় অংশটি আলোচিত সময়ে ভিন্নমত দমন, নাগরিক নিগ্রহ কিম্বা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোর বেলায় নীরবতা পালন করে এসেছেন। তেঁতুলতলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে পুলিশ এখন যে সরকারসমর্থক বুদ্ধিজীবিদেরও ক্ষমতা অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল করাতে পেরেছে, এটাও একধরণের প্রাপ্তি বটে। প্রশ্ন হচ্ছে নাগরিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে তাঁরা খেলার মাঠ রক্ষার বাইরে আদৌ পা বাড়াবেন কি না? বাড়ালেও তা কত দূর পর্যন্ত?
অবশ্য নাগরিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে ফেসবুকের মত সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকার বিষয়টি আলোচনা না করলেই নয়। রাজপথে বিষয়টি নিয়ে যতটা উত্তাপ দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে তা ছিল তার বহুগুণ। ফেসবুকের মতামতের মূল্য সরকারও বুঝতে শুরু করেছে মনে হয়। ফেসবুকের আলোড়নে তাই সরকারি সিদ্ধান্ত দ্রুতই বদলে যাওয়ার কিছু নজিরও তৈরি হয়েছে। অনেকের ধারণা, সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলেকে আটকে রাখার পর মামলা না দিয়ে রাতের বেলায় মুক্তি দেওয়ার কারণও ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া। সামাজিক মাধ্যমের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের অরাজনৈতিক দাবি-দাওয়া পূরণের অবশ্য অন্য আরেকটি কারণও থাকতে পারে। দেশে গণতন্ত্রহীনতার যেসব অভিযোগ আছে, তার জবাবে সরকার আন্তর্জাতিক পরিসরে এগুলোকে নিজেদের গণতান্ত্রিক আচরণের নজির হিসাবে কাজে লাগাতে পারে।
ফেসবুকে অবশ্য সংগঠিত রাজনৈতিক কার্যক্রম খুব একটা ভিত্তি দাঁড় করাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার ও আহ্বান জানানোর সুবাদে ছাত্ররা আন্দোলনে যেভাবে নেমে পড়েছিল, সেভাবে কোনো রাজনৈতিক প্রতিবাদ আজও সংগঠিত হতে দেখা যায় নি। তবে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সরকারের তোড়জোড় চলছেই। সম্ভাব্য সরকারবিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে, সে জন্যি এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেই জনমনে ধারণা জোরদার হচ্ছে। নাগরিক অধিকারের জন্য যাঁরা সোচ্চার হচ্ছেন, তাঁদের তাই ইন্টারনেটের স্বাধীনতার কথাও বলা দরকার। তবে উন্নত দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বা সামাজিক অধিকারের আন্দোলনের মূল জায়গা কিন্তু এখনও রাজপথ বা মাঠের আন্দোলন। সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটের ভূমিকা এক্ষেত্রে হচ্ছে সহায়ক হাতিয়ার।
(২৮ এপ্রিল, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন