আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বলে উভয় দেশ এবং তার বাইরেও মোটামুটি একটা জোরালো ধারণা চালু আছে। কদিন আগে ঢাকায় জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে। আজ সোমবার শুরু হতে যাওয়া চারদিনের এ সফরকে ঘিরে ভারতে সরকারি পর্যায়ে যে উঁচুমাত্রায় আশাবাদ তৈরি হয়েছে, তা এ মন্তব্যে স্পষ্ট। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে অবশ্য এখনো পর্যন্ত এই সফরের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রত্যাশার কথা বলা হয়নি।
ভারত ও বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার আশাবাদের কথা শুনলে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৮ সালের একটি মন্তব্যই সবচেয়ে বেশি কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, , ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি, গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।’ ওই বছরের ৩০ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শিরোনামে খবর ছাপানোর পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি কোনো প্রতিদান চেয়েছেন কি না এবং চাইলেও কোনও আশ্বাস পেয়েছেন কি না?
আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা যে বেশ জোরালোভাবে চালু আছে, সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীরের কথায়। অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা)’ সইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে দুই দেশ চুক্তি শুরুর বিষয়ে আলোচনা করতে চায় বলে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, সে বিষয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, `চুক্তিটিতে দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ কর্ যাতে সুষম হয় এবং পরস্পরের জন্য সুফল বয়ে আনে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কাজেই এই চুক্তি যদি একপক্ষীয় হয়, তবে এটি টেকসই হবে না।’
বাংলাদেশ বেশি দিচ্ছে আর পাচ্ছে কম ধারণা তৈরির পেছনে যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, তার একটা ছবি উঠে এসেছে বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক বণিক বার্তায়। `বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য জটিল রূপ নিচ্ছে` শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত—এ তিন দেশেরই সফট পাওয়ারের (বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা) প্রভাব দিনে দিনে বাড়লেও `বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ।` বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি বলছে, দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের ( প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ) পরিমাণ এখন ৪৩৯ কোটি ডলারের বেশি। এদিক থেকে চীনের অবস্থান পঞ্চম এবং তার এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রায় ১৪৪ কোটি ডলার। আর ভারতের অবস্থান দশম ও ভারতীয় এফডিআইয়ের পরিমাণ ৭৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
বাণিজ্যেও এ তিনটি দেশের প্রাধান্য দৃশ্যমান। বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির প্রায় অর্ধেকই আসে দেশ তিনটি থেকে, যার উৎস হিসাবে সবার উপরে চীন। চীন থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৯২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় উৎস ভারত থেকে একই অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮৫৯ কোটি ডলারের বেশি পণ্য, যা মোট আমদানির প্রায় ১৭ শতাংশ। পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান একেবারেই নগণ্য, যার পরিমাণ একই সময়ে ছিল ২২৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু রপ্তানিতে চিত্রটা একেবারেই উল্টো। বাংলাদেশী পণ্যের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৬৯৭ কোটি ডলারের বেশি। একইসময়ে ভারতে পণ্য গেছে প্রায় ১২৮ কোটি ডলার, আর চীনে গেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের সামান্য বেশি।
একসময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় বাণিজ্যঘাটতির বিষয়টি বড় অস্বস্তির কারণ থাকলেও আমাদের আমদানি চাহিদার ব্যপকতা ও রপ্তানিপণ্যের সীমাবদ্ধতার বাস্তবতায় সে বিষয়টি আর বড় সমস্যা হিসাবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অনুদার নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। যখন দেশে পেঁয়াজের অভাব হয়, তখন দেখা যায় ভারত তার রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে। চাল ও গমের ক্ষেত্রেও একই নীতির পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। প্রতিবেশির প্রতি সহানুভূতির এই ঘাটতি কতটা প্রকট রুপ নেয়, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত করোনা মহামারির সময়েও দেখা গেছে। আগাম টাকা দিয়েও বাংলাদেশ চুক্তিমতো টিকা পায়নি। বিপদের সময়ে বিকল্প উৎস সন্ধান করাটাই এখন বাংলাদেশের করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতোই ভারতের বিনিয়োগের বেশিরভাগই অবকাঠামো খাতে। তবে ভারতের অগ্রাধিকার মূলত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে, যার সুফল সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে তারাই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন এখন কম খরচে ও স্বল্পতম সময়ে সম্ভব হচ্ছে। এখন এ সুবিধা আরও সম্প্রসারণে বেশ কিছু প্রকল্প আলোচনায় আছে। বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্য ও মানুষের নেপাল কিম্বা ভুটানে যাওয়ার সুবিধা এখনও অবাধ হয়নি। জ্বালানিখাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে, কিন্তু রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত ক্ষতির বোঝাটা বাংলাদেশকেই বইতে হবে। কোনো বিরোধিতা ও উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া হয় নি। জ্বালানি খাতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরতা বাড়ানোয় নেপালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও এক্ষেত্রে স্মরণ রাখা জরুরি।
সুসম্পর্কের সাফল্য হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল ও সামুদ্রিক সীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তির কথা প্রায়ই বলা হয়। স্থল সীমান্তের বিরোধ যে চার দশক ধরে অনিষ্পন্ন ছিল তার দায় বাংলাদেশের নয়। কেননা, বাংলাদেশ বহু আগেই সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করেছিল। আর সমুদ্র সীমা চিহ্নিত করার কাজটি হয়েছে আন্তর্জাতিক সালিসে। সবচেয়ে উদ্বেগ ও হতাশার বিষয় হচ্ছে, স্থলসীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও সীমান্তে বেসামরিক বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ হয়নি এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনীর কর্তাব্যাক্তিদের বক্তব্যে এখনও এসব হত্যার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অব্যাহত। নিহত বাংলাদেশিদের চোরাচালানি হিসাবে অভিহিত করে তাদের বিনা বিচারে হত্যার নীতি বন্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অথচ সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের লোকজনের বিরুদ্ধেই চোরাচালানির একাধিক মামলার এখন তদন্ত চলছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আর যে বিষয়টিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তা হলো গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি। যদিও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ তার পানির হিস্যা ঠিকঠাক কখনো পেয়েছে, এমন দাবি কোনো পক্ষই করে না। আরও অর্ধশতাধিক অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের চুক্তির বিষয়ে আলোচনা ও সহযোগিতাও ঝুলে আছে। ১৯৭২ সালে গঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৮তম বৈঠক হয়েছে ঠিক এক যুগ পর দিল্লিতে গত ২৫ আগষ্ট। অগ্রগতি বিবেচনা করলে বৈঠকের জন্য ১২ বছরের জড়তা কাটানোই বিরাট। কুশিয়ারার পানি বন্টনের বিষয়েও একটি সমঝোতা হয়েছে, চূড়ান্ত হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরের খাবার পানির সমস্যা মেটাতে পানি প্রত্যাহারের স্থানও। বন্যাসতর্কীকরণ ও নদীর পানি দূষণের মতো বিষয়গুলোও আলোচনা হয়েছে। তবে গঙ্গার পানি বাংলাদেশ যতটা পায়, তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনায় সম্মত হওয়ার বিষয়টি অনেক বিশেষজ্ঞকে অবাক করেছে। ভাটির দেশে চুইয়ে আসা পানির ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিবেশির ভূমিকা কী, তা বোঝা মুশকিল।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলায় দুই দেশেই যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তার খুব নির্মম উপসংহার টেনেছে ভারতের পুরোনো পত্রিকা দ্য স্টেটসম্যান। পত্রিকাটি বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে বলেছে, এই মন্তব্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে যে ইঙ্গিত গেছে, তা হলো পররাষ্ট্র নীতি ও দর্শন নির্ধারণে বাংলাদেশের পেশাদার কূটনীতিকদের সামর্থ্য মানসম্মত নয় (এ স্টর্ম দ্যাট ক্লাউড হার্ট টাইস)। এ রকম পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্বই আলাদা।
(৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন