ছয়টি সংসদীয় আসনে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচন। তবে সংবাদমাধ্যমের বাড়তি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে একটি আসনে। মনে হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আসনটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কৃতিত্ব যত না সেখানকার প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ আসনটি তাঁকে শুধু ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দলের সাংগঠনিক শক্তিও তাঁকে ধার দিয়েছে। নির্বাচনী সভা–সমাবেশ সবকিছুই করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জেলার অন্য এমপি, জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারাও। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে একজন প্রাক্তন বিএনপি নেতা যদি এত মূল্যবান হন, তাহলে বর্তমান বিএনপির নেতারা কি তাঁর চেয়ে কম কিছু হবেন?
এমনিতেও অবশ্য আসনটির উপনির্বাচনে বাংলাদেশে নতুন একটি নজির তৈরি হতে যাচ্ছে, যাতে মাত্র নয় সপ্তাহ আগে আসনটি থেকে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে পদত্যাগের পর আবার জনগণের ম্যান্ডেট চাইছেন বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আব্দুল সাত্তার। বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই জনপ্রতিনিধিদের দল পরিবর্তনের পর ভোটারদের কাছ থেকে নতুন করে ম্যান্ডেট চাওয়ার চর্চা আছে। কেননা, সাধারণভাবে মনে করা হয় যে একজন পার্লামেন্ট সদস্য শুধু নিজের নয়, তাঁর দলের রাজনীতি ও কর্মসূচিরও প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু উকিল সাত্তারের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু ঘটে নি।
তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বিএনপির অন্য পাঁচজনের সঙ্গে একজোট হয়ে। আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলে যোগ দেওয়ার কথাও বলেননি। তাহলে নতুন করে ভোট চাওয়ার যুক্তি কী? তাঁকেই যদি ভোটারদের ভোট দিতে হয়, তাহলে তো ভোটাররা তাঁর কাছে উপনির্বাচনের খরচ দাবি করতে পারেন। দেশ যখন আর্থিক টানাটানির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, নানা ধরনেরর জরুরি খরচেও লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছে সরকার, তখন একই ব্যাক্তিকে একই সংসদের বাকি বছরখানেকের মেয়াদ পূরণের জন্য ভোটাররা ভোট দেবেন কেন?
এসব প্রশ্নের উত্তরে অনেকেরই সন্দেহ তাঁকে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি এবং তার সঙ্গে জোট বাঁধা দলগুলোর রাজনীতিকদের কাউকে কাউকে পক্ষত্যাগে প্রলুব্ধ করতে চাইছে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি ভাঙ্গা ও বিএনপির বিকল্প দাঁড় করানোর বহু চেষ্টাই হয়েছে। উকিল সাত্তারকে নিয়ে সেরকম নতুন কোনো উদ্যোগ দেখা গেলে, তাই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বরং, সেরকমটিই অনেকের ধারণা। তাঁকে মন্ত্রীসভায় জায়গা দিয়ে হলেও সে রকম চেষ্টার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। অতীতে সে রকম নজির আছে এবং সেটা আওয়ামী লীগেরই। ’৯৬–এর সংসদে বিএনপিকে কাবু করতে দুজন এমপিকে মন্ত্রী বানিয়ে সাময়িক লাভের চেয়ে তাদের ক্ষতি কিন্তু কম হয়নি। দল ভাঙ্গা তো দূরের কথা দলবদলের জন্য আলাউদ্দিন আহমেদ ও হাসিবুর রহমানের এমপি পদে থাকা আইনগতভাবে অবৈধ হলে প্রমাণ হয় যে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে জাতীয় সরকারের নামে আওয়ামী লীগ একটি বেআইনি ও অনৈতিক কাজ করেছিল। এবারে তো জাতীয় সরকারের কোনো সুযোগই নেই, যেহেতু সংসদ তো প্রায় একদলীয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা একজন সাবেক বিএনপি নেতার চারিত্রিক সততার যে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। ’বিএনপির দলছুট সাত্তারের সঙ্গে একই মঞ্চে আ. লীগ নেতারা’ শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, 'বর্ষীয়ান উকিল আব্দুস সাত্তার একজন সৎ রাজনীতিবিদ। বিএনপিতে থাকার সময় দল থেকে সম্মান পাননি বলেই তিনি বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সৎ সাহস নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।’
গত অক্টোবর থেকে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে যেভাবে সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলেছে, এগুলো যে তারই প্রতিক্রিয়া, সেটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বিএনপির সমাবেশগুলো যদি পন্ড হয়ে যেত, যে চেষ্টা সব জায়গাতেই হয়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে এমন নাটকীয়তা হয়তো আমাদের দেখতে হতো না। শুধু বিএনপিকে দূর্বল করার চেষ্টা নয়, আমরা এখন ক্ষমতাসীন দলের নতুন নতুন মিত্র সন্ধান করার আপ্রাণ চেষ্টাও দেখতে পাচ্ছি। নিজেদের জোট যেটি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, তাকে সচল করতে নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দুটো আসনও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়া অন্য আসনগুলো নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কোনো মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয় না। জোটের দূর্বল সঙ্গীদের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো কোনো তৎপরতা নেই। ’কয়েকজন এমপি পদত্যাগ করলে সংসদের কিছু হয় না’ – আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্য নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। উপনির্বাচনগুলোর ফলাফলেও বর্তমান সংসদের কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটবে না। সংসদ বাস্তবে বিরোধী দলহীনই থাকবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সহযোগী জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধীদলীয় আসনে একই ভূমিকায় থাকবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য কথিত ৫৪ দলের সমঝোতাকে সরকার হটানোর জন্য ’অতি বাম, ডান মিলেমিশে একাকার হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। কথাটা সরকারবিরোধীদের ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য, ঠিক ততটাই সত্য আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চরম ডানপন্থী হেফাজতে ইসলামসহ একাধিক ইসলামী সংগঠন এবং গত নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকা কৃষক–শ্রমিক পার্টির নেতা কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাতে তার আভাস মেলে। ১৮ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী আমির হোসেন আমুও জানিয়েছেন, কয়েকটি ইসলামী দল জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। জোটের শরীক বাম নেতাদের সম্মতি না পেলেও বিরোধিতা থেকে নিবৃত্ত করা গেলেই তা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা যায়। এক্ষেত্রে গত নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন আদায় এবং সাবেক স্বৈরশাসক প্রয়াত এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি মেনে নেওয়ার নজির স্মরণ করা যায়।
দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং নানারকম মামলা–হামলায় বিপর্যস্ত একটি দলের পক্ষে এসব কৌশল মোকাবিলা যে দুরুহ কাজ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অক্টোবরে শুরু হওয়া আন্দোলনের শক্তি ক্ষয়ের জন্য ইতোমধ্যে মামলাও হয়েছে কয়েকশ’, গ্রেপ্তার হয়েছেন আরো বেশি এবং মামলার আসামী হয়েছেন বিএনপির দাবিমতে প্রায় কুড়ি হাজার। বিদেশি সংবাদমাধ্যম, বিশেষত ভারতীয় পত্র–পত্রিকায় বিএনপির এই ঘুরে দাঁড়ানোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে। বিএনপিকে মোকাবিলায় দমনপীড়নের জন্য দেশে–বিদেশে সরকারের সমালোচনা বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নিজস্ব শক্তি ও রাজনীতির প্রতি আস্থায়ও চিড় ধরেছে। না হলে বিএনপির একজন দলছুট নেতাকে জিতিয়ে আনতে এতো আয়োজন কেন?
(২৬ জানুয়ারি, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন