সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ

 সরকার ১০ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কমিশনারের শূণ্য পদে নিয়োগের জন্য যোগ্য ব্যক্তি বাছাই ও সুপারিশ করার জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে । মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে প্রধান করে গঠিত বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান, মহা–হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন ও সর্বশেষ অবসরে যাওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার। 


আপাতদৃশ্যে আইন আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করে গঠিত এ কমিটি গঠন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। কারণ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ৭(১) বলছে : কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত পাঁচ জন সদস্য সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হইবে, যথা:- (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের একজন বিচারক; (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রীম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; (গ) বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; (ঘ) সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান; এবং (ঙ) অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। আইনে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সম্পর্কে অবশ্য আরেকটু ব্যখ্যা যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে: তবে শর্ত থাকে যে, যদি উক্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি বাছাই কমিটির সদস্যপদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অব্যবহিত পূর্বের অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব; আরও শর্ত থাকে যে যদি উক্তরূপ কোন অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি বাছাই কমিটির সদস্যপদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে বর্তমানে কর্মরত মন্ত্রিপরিষদ সচিব৷


দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার দ্দেশ্যে আইনে কোনো রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন অথবা বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধিত্বের সুযোগ রাখা হয় নি। কিন্তু বাস্তবে এখন যা ঘটেছে, তা হচ্ছে সর্বশেষ অবসরে যাওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। মাত্র তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদে আসীন থাকার পর অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে গিয়ে তিন দিনের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার পেয়েছেন। ৫ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যে কক্ষে যে আসনটিতে বসেন, সেটি ছিল প্রয়াত এইচ টি ইমামের। এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো–চেয়ারম্যান ছিলেন। সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন ওঠে তিনি ওই পদে দায়িত্ব পাচ্ছেন। তাঁকে সেদিন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। 


এর দু’দিন পর আওয়ামী লীগে দায়িত্বপ্রাপ্তির ব্যাপারে কবির বিন আনোয়ারকে উদ্ধৃত করে প্রতিদিনের বাংলাদেশ জানায়, ‘সামনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করে আমি দলীয় কার্যালয়ে অফিস করা শুরু করেছি।’ তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি কী দায়িত্ব দিয়েছেন সে ব্যাপারে তখনই বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি তিনি (‘শেখ হাসিনার দেওয়া দায়িত্ব’ নিয়ে আ.লীগে কবির বিন আনোয়ার, জানুয়ারি ৮, ২০২৩)। ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রশ্ন ওঠে যে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকার সময়ে সরকারি বেতন–ভাতা পাওয়ার কারণে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন কি না? এ প্রশ্ন ওঠার কারণেই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, তাঁর ওই দায়িত্বে নিয়োগের দলীয় ঘোষণা এখনো আসেনি। দলীয় দায়িত্ব বন্টনের ঘোষণা আসুক, আর না–ই আসুক, তিনি যে আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়েছেন, সে বিষয়ে আর সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।  


দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে বাছাই কমিটি থেকে তাঁর সরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গত কদিনে এরকম কোনো খবর চোখে পড়েনি যে তিনি স্বেচ্ছায় ততটা উদারতা দেখাবেন। ফলে বাস্তবে এখন এ বাছাই কমিটিতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ঘটছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন দেশেই এগুলোর শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগে প্রক্রিয়াকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। যদি সেখানে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থাকে, তাহলে তাতে ভারসাম্য আনার জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। আমাদের আইনটির উদ্দেশ্য সে রকমই ছিল। বিচারবিভাগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও সরকারি কর্ম কমিশন এ তিনটিই সাংবিধানিকভাবে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা এবং তত্ত্বগতভাবে স্বাধীন। আর সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অর্ন্তভুক্তির বিধান করার সময়ে নিশ্চয়ই আইনপ্রণেতাদের চিন্তায় আসেনি যে অবসরের পর দেশের সর্ব্বোচ্চ পদে দায়ত্বপালনকারী আমলা এত দ্রুত কোনো রাজনৈতিক দলে সক্রিয় হবেন।   


পাঁচজনের কমিটিতে একজন রাজনীতিসক্রিয় ব্যক্তি আর কতটাই ভূমিকা রাখতে পারেন, এমন প্রশ্ন তুলে কেউ হয়তো বিষয়টির গুরুত্ব লাঘব করার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ’বিশেষ দলীয় দায়িত্ব’ পাওয়া ব্যক্তির মতো কেউ কমিটিকে কোনোভাবে প্রভাবিত করবে না, সে কথা কোনোভাবেই বলা যায় না। এমনকি দুজন বিচারপতির মতকে এড়িয়েও ওই কমিটিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়া সম্ভব। কেননা, দুদক আইনের ৭(৪) এ বলা হচ্ছে : ’উপস্থিত সদস্যদের অন্যুন ৩ (তিন) জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে’ নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যাবে। দেশের সব প্রতিষ্ঠান যেভাবে রাষ্ট্রের কবজাধীন হয়ে আছে, তাতে এমন আশংকা নাকচ করা সহজ নয়।  


দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে বিরোধী দল, বিশেষত: বিএনপির অনেকদিনের অভিযোগ যে প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত ১৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ অভিযোগের পনুরাবৃত্তি করে বলেছন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন বিএনপি দমন কমিশনে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, দ্বিধা ও অনাগ্রহের অভিযোগও নতুন কিছু নয়। 


কমিশনের সদস্যরা দলীয় আনুগত্য ও রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন বলে যে জনপ্রত্যাশা ও ধারনা চালু আছে, তা–ও ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাবেক একজন কমিশনার তাঁর মেয়াদশেষে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়েছিলেন এবং উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যও হয়েছিলেন। কমিশনে দায়িত্ব পালনের পরও দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্ভব, তা আইনপ্রণেতাদের বিবেচনায় ছিল বলে মনে হয় না। তাহলে সম্ভবত আইনে তা থেকে বিরত রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপিত হতো।


নিয়োগপ্রক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার নজিরে যে নতুন সংযোজন ঘটছে, দীর্ঘমেয়াদে তার ফল কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। আইনের মোড়কেই অনুমিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক রুপায়ন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সে প্রশ্ন তাই মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। 


(২০ এপ্রিল, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...