সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে নির্বাচন হয় যেভাবে

 আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের রাজনীতিকেরা প্রায়ই ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন এবং সম্ভবত সে কারণেই বৃটেনের নির্বাচনের কথাও টানা হয়। সমস্যা হলো তাঁরা হয় জেনেশুনে, অর্থাৎ সজ্ঞানে ওয়েস্টমিনস্টার মডেল সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা তৈরির চেষ্টা করেন, নয়তো তাঁরা নিজেরাই তা জানেন না। ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্র আর যা–ই হোক, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়; দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেখানে আইন ও নীতি প্রণয়ন হয় না। বরং জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা হয় নানারকম প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রথাগত সৃজনশীল উপায়ে। ওই ব্যবস্থায় এমপিদের প্রথম আনুগত্য তাঁর এলাকার ভোটারদের প্রতি, তারপর দল এবং তারও পরে দলের নেতার প্রতি।     

কোভিড মহামারিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করায় আইনভঙ্গের জন্য  প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে পুলিশের জরিমানার কথা কি এত দ্রুত ভুলে যাওয়া উচিত? শুধু পুলিশের জরিমানা কেন, ওই একই বিষয়ে পার্লামেন্টে ঠিক তথ্য না দেওয়ায় পার্লামেন্টে তাঁকে ৯০ দিনের জন্য অবাঞ্ছিত  ঘোষণা করা হয় যে পার্লামেন্ট রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তাঁর দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ, যে কমিটি সর্বসম্মত সুপারিশ করেছে, সেই কমিটিতেও তাঁর দলের প্রতিনিধিত্ব বেশি ছিল কথিত সাংবিধানিকতা ছাড়াই ওই গণতন্ত্রে আইনের শাসন এমনই যে একজন আমলাও নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তরের আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত করতে পারেন


ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে ডাউনিং স্ট্রিট কিংবা চেকারসে প্রধানমন্ত্রীর বাগানবাড়িতে দলীয় সভা - তা সে পার্লামেন্টারি বোর্ড হোক, কিংবা কোনো কমিটির সভা - সেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকা অচিন্তনীয় করদাতার অর্থ বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ কোনো দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কোনো অবকাশ সেখানে নেই রাজনৈতিক দলকেও জানাতে হয় তারা কোত্থেকে টাকা পেল কেউ মাত্র ৫০০ পাউন্ড চাঁদা দিলেই দাতার পরিচয় প্রকাশ করারও আইনি বাধ্যবাধকতা আছে দলের তহবিলের হিসাবে কোনো অনিয়ম ঘটলে কী হয়, তার প্রমাণ স্কটল্যান্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টারজেন এবং তাঁর স্বামীর গ্রেপ্তারেও দেখা গেছে


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে নির্বাচন কীভাবে হয় প্রশ্ন করেন, তখন এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে তিনি তা জানেন না।  সেখানে নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাউস অব কমন্স ভেঙে যায়, সংসদ সদস্যরা আর সংসদ সদস্য থাকেন না সেই হিসাবে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা তখন কেয়ারটেকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তখন তাঁরা আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন তাঁদের সুযোগ-সুবিধা প্রায় সবই পরিত্যাগ করতে হয় বস্তুত নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ আমলাদের অনুমতি দেন যাতে তারা ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্য বিরোধী দলগুলোকে সরকারি কার্যক্রমের বিষয়ে সব ধরনের তথ্য সরকারিভাবে দিতে পারে বিরোধীরা কোনো বিষয়ে তথ্য চাইলে, তা ন্যূনতম সময়ের মধ্যে তাদেরকে জানানোর বাধ্যবাধকতাও আছে সরকারি কর্মচারীদের জন্য তখন পর্দাপ্রথা নামে পরিচিত ব্যবস্থা চালু হয়, যাতে তারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করতে পারেন না, মন্ত্রীদের প্রচার কাজেও কোনো সহায়তা দিতে পারেন না


নির্বাচন বিষয়ক আইনকানুন তৈরি হয় আলোচনা সমঝোতার ভিত্তিতে, একতরফাভাবে নয় আগে একসময় প্রধানমন্ত্রীরা তাঁদের যখন সুবিধা হবে বলে মনে করতেন তখন আগাম নির্বাচন দিতে পারতেন এখন সেই সুযোগ রহিত হয়েছে পার্লামেন্টের মেয়াদ নির্দিষ্ট করার আইন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আস্থা ভোটে হারলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অন্য যিনি আস্থা অর্জন করবেন, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী নতুবা সব দলের আলোচনা সমঝোতার ভিত্তিতেই পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন করা হয় আমাদের সংবিধানের ৭০ ধারা কী কোনো দলে এভাবে নেতৃত্বের জবাবদিহির অবকাশ রেখেছে? নেতার ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করাই যেখানে ৭০ ধারার লক্ষ্য সেখানে ক্ষমতাসীনদের সাংবিধানিকতার লক্ষ্য তো ভিন্ন কিছু হতে পারে না


ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সাম্প্রতিক ইতিহাসে দলকে সর্ব্বোচ্চ ব্যবধানে নির্বাচনী বিজয় এনে দিয়েছিলেন যিনি, সেই বরিস জনসনকে সংসদীয় তদন্তে শুধু দোষী সাব্যস্ত করেই পার্লােমন্ট ক্ষান্ত হয়নি. পার্লামেন্টের অবমাননার জন্য পার্লামন্টের চৌহদ্দি , ওয়েস্টমিনস্টারে তাঁর প্রবেশাধিকার ৯০ দিনের জন্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁর অন্ধ ভক্ত যে কজন সংসদ সদস্য পার্লামেন্টারি তদন্তকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই সহকর্মীদের নিন্দা করতেও কেউ দলীয় পরিচয় বিবেচনায় নেয়নি।


ব্রিটেনের নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধায়ক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে  প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি শ্রদ্ধা, তার সমঅধিকারের স্বীকৃতি,  রাজনীতিবিদদের সংযত আচরণ এবং প্রশাসন ও রাষ্ট্রের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকা। প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নীতি পর্দাপ্রথা শুধু যে সরকারি কর্মচারিদের ওপর প্রযোজ্য হয়, তা নয়; সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ কাউন্সিল ও নগর পরিষদও এ নীতি প্রতিপালনে বাধ্য। 


ব্রিটেনে ভোটগ্রহণ ও গণনার জন্য নির্বাচন কমিশনের কোনো নিজস্ব কর্মী নেই। বিভিন্ন কাউন্সিলের কর্মীরাই কাজটি করে থাকেন এবং কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী বা জৈষ্ঠ্য কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। যেসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় অর্থ  বরাদ্দ বা অনুদান পেয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রেও ওই নীতি অবশ্য পালনীয়। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় হয় না, পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতেই হয়ে থাকে। ফলে নির্বাচনে দলীয় প্রভাব খাটানো বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো অবকাশ এতে নেই। বেসরকারি বা বাণিজ্যিক রেডিও–টিভিকেও সব দলের প্রতি সমসুযোগ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়।   

   

ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের তুলনা করতে পারি, রাজনীতিকেরা যদি আগে সেই প্রশ্নটির সদুত্তর দিতে পারেন, তাহলে হয়তো ওই মডেলে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরির কথা ভাবা যায়। কিন্তু, দূর্ভাগ্য হচ্ছে, নব্বুইয়ের গণ–অভ্যূত্থানের সময়ে আমরা সেই পথে অনেকটা অগ্রসর হওয়ার পর সেখান থেকে পিছু হটতে হটতে এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে স্বৈরশাসক এরশাদের অনুসারীরা এখন উপহাস করার সুযোগ পায়। 


(২৮ জুলাই, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...