২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকায় সমাবেশ ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলি নি:সন্দেহে সমসাময়িক কালে রাষ্ট্রে তোলপাড় তৈরি করা একটি ঘটনা। সে দিনের সমাবেশ ঘিরে হঠাৎ যে উত্তাপ ও তান্ডব ঘটে গেছে, তার প্রভাব রাজনীতিতে এখনো গভীরভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু ঘটনাটি সম্পর্কে সব প্রশ্নের যে উত্তর মিলেছে, সে কথা কেউই বলতে পারি না । সরকারিভাবে বলা হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ন্যূনতম শক্তিপ্রয়োগ করে হেফাজতের সমাবেশে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দিয়েছে। নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির আজও নিরসন ঘটেনি।
২০১৩ সালের ৯ নভেম্বরের সমকাল পত্রিকার একটি সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে, ’হেফাজতের তান্ডবের শ্বেতপত্র’। তার নীচে একটু ছোট করে দুটো তথ্য দেওয়া আছে, ’মৃতের সংখ্য ৩৯ জন’, এবং ’জামায়ত নিষিদ্ধের দাবি’। শ্বেতপত্রটি প্রকাশ করেছিল বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত একটি গণকমিশন, যার সদস্যসচিব ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। সমকালের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সরকারি উদ্যোগে কমিশন গঠন না করায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে ওই গণকমিশন গঠন করা হয়।
গণকমিশনের শ্বেতপত্রে বলা হয় ৫ মে রাতে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার পর বিএনপি–হেফাজত বলেছিল হাজার হাজার লোক মারা গেছে। গণকমিশন হেফাজতের কাছ থেকে পেয়েছিল ৭৯ জনের তালিকা। অ্যামনেস্টি বলেছিল ৪০ জন। অধিকার সম্পর্কে বলা হয়, তারা প্রথমে যা বলেছিল, তা একাধিকবার সংশোধন করে সর্বশেষ ৬১ জনের কথা বলেছে। ওই শ্বেতপত্রেই বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৈরি করেছিল ২৮ জনের তালিকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকাটি কখনো প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্নসময়ে সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা নিহতের সংখ্যা ১১ বলে জানিয়েছেন।
গণকমিশন তাদের শ্বেতপত্রে বলেছিল, ওইসব তালিকা অতিরঞ্জিত ও অসম্পূর্ণ। শ্বেতপত্র প্রকাশের অনুষ্ঠানে চারজনের পরিবার ছিল, যাদের মধ্যে দুজন হেফাজতের, একজন জামায়াতের এবং একজন আওয়ামী লীগের। ওই চারটি পরিবারের প্রতিটিকে সেই অনুষ্ঠানে সাহায্য হিসাবে ১০ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শ্বেতপত্রেই দেখা যাচ্ছে, সরকারের প্রকাশিত সংখ্যা আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ফারাক আছে এবং তা বেশ বড় ফারাক, প্রায় আড়াই গুণ। গণকমিশনের সংখ্যাও সরকারিভাবে প্রকাশিত সংখ্যার সাড়ে তিনগুণ। এতে অ্যামনেস্টির যে সংখ্যা উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেটা আসলে ছিল ৪৪। ৭ মে অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে বলা হয়েছিল ৫ ও ৬ মে দুই দিন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলিয়ে ওই হেফাজতের সমাবেশ সম্পর্কিত সহিংসতায় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য তিনজন এবং সাধারণ বা বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ৪১। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, নিহতের সংখ্যা তারা পেয়েছে ৫৮ জন।
অধিকারের তালিকা নিয়ে এত বিতর্ক হলেও প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে তারা কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি, শুধু সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে তালিকা চাওয়া হলে তারা বলেছিল, ঘটনা তদন্তে কোনো বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করা হলে শুধু তাদের কাছেই তারা ওই তালিকা হস্তান্তর করবে। কারণ হিসাবে তারা দাবি করেছিল, তালিকা সরকারের কাছে দেওয়া হলে নিহতদের পরিবারগুলো ভয়ভীতি দেখানো বা হয়রানির ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন দেশেই এমন কৌশল অনুসরণ করে থাকে, বিশেষ করে অভিযোগ যদি আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে হয়। গুমের তালিকা নিয়ে পরবর্তীতে এ রকম হয়রানির অভিযোগ ভূক্তভোগী পরিবারগুলোর সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে করেছেন।
হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে ভুল বা বানোয়াট তথ্য প্রচার করে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি বা বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগে সরকার আর কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। মামলা হয়েছে শুধু অধিকারের দুই নির্বাহী আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে। মামলার পর তাঁদের দুজনকে ওই বছরেই আগস্টে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাঁদের দুজন বিশেষ কোনো কারণে সরকারের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। পরবর্তী বছরগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে হেফাজতের যে সখ্য গড়ে উঠেছে, তাদের বিভিন্ন দাবি পূরণ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীকে ’কওমি জননী’ খেতাব প্রদানের পটভূমিতে অধিকারের কথিত অপরাধ তো আর অপরাধ থাকার কথা নয়।
অধিকারের এ দুজন নির্বাহীকে গ্রেপ্তারের সময়ে তাদের অফিস থেকে কম্পিউটারগুলো পুলিশ জব্দ করে এবং সেগুলো তাদের আর ফেরত দেওয়া হয়নি। আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেটা অধিকারের তালিকা নয় বলে তাঁদের আইনজীবি দাবি করেছিলেন। কিন্তু সরকার ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ কয়েকজনের নাম প্রকাশ করে দাবি করে যে তাদের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে, তালিকায় জীবিত ব্যক্তিদের নাম ঢুকিয়ে বানোয়াট তথ্য প্রচার করা হয়েছে। তাঁদের দুজন এবং অধিকারের বিরুদ্ধে নানারকম অপবাদ দিয়ে প্রচার চালানো হয় যে তাঁরা বিএনপি–জামাতের হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের কাজ করছে।
বিএনপি জোটের শাসনামলে একজন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসাবে তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার কাজ করলেও বিএনপি কিম্বা জামাতে কখনো যোগ দিয়েছেন বলে জানা যায় না; বরং ২০০১ সালের নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতদের পরিসংখ্যান দিয়ে অধিকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। একইভাবে ২০০৪ সাল থেকে তারা নিয়মিত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে ক্রসফায়ার, হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন, যৌথবাহিনীর অভিযান, বিনা বিচারে আটক রাখাসহ সব ধরণের মানবাধিকার লংঘনের পরিসংখ্যান ও বিবরণ প্রকাশ করে এসেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এখন যেভাবে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, সম্ভবত সেই মানসিকতা ও ধারনা থেকেই আদিলুরকে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেখানোর নিরন্তর চেষ্টা চালানো হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে যেসব বিশেষজ্ঞ ও কমিটি জাতিসংঘের হয়ে কাজ করে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছে যে অধিকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। গুম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির কথা এক্ষেত্র উল্লেখ করা যায়। অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ৭২টি আর্ন্তজাতিক সংগঠন তাদের বিবৃতিতে তাই অভিযোগ করেছে, র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে অধিকারের বিরুদ্ধে সরকারের হয়রানি ও চাপ বেড়েছে। পরের বছর সরকার অধিকারের নিবন্ধন নবায়নের আবেদন নামঞ্জুর করেছে। আর ২০১৪ সালের পর থেকেই সরকার তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করে দিয়েছে। এসব ধারাবাহিক হয়রানিকে তাই দেশি– বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে আক্রোশ হিসাবে বর্ণনা করছে, তা নাকচ করা তাই সহজ নয়।
আদিলুর ও নাসির উদ্দিন জুটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে, যে আইনটি এ পর্যন্ত দু’বার পরিবর্তন হয়েছে – প্রথমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন। তাঁদের যেদিন আদালত দন্ড দিলেন, সেদিনেই সর্বসাম্প্রতিক পরিবর্তন এনে সাইবার আইন নামে সেটি সংসদে পাশ করা হয়। আইনটিকে এখনও দেশে–বিদেশে নিবর্তনমূলক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে সমালোচিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব মামলা বাতিল এবং ওইসব মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের সুপারিশ ছিল জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের। পরিহাসের বিষয়, সেই আইনেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুজন মানবাধিকাররক্ষীকে সাজা দেওয়া হলো।
আদিলুর ও নাসির উদ্দিনের বিচারেও সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের মনে হয়েছে, তাঁদের দোষী প্রমাণের জন্য ঘটনার ১০ বছর পর নতুন করে তদন্ত দরকার। আদালত সেই বিরল তদন্তের অনুমতিও দিয়েছেন এবং বর্ধিত তদন্তের পর দ্রুততম সময়ে বিচার শেষ করা হয়েছে। ফলে এই বিচার এবং দন্ড নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
(২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন