আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার নিয়মিত পর্যালোচনায় ৯০ ভাগের মতো দেশ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতির প্রশংসা করে গঠনমূলক সুপারিশ করেছে। আইনমন্ত্রীর এই প্রায় বিশ্বজয়ে মন্ত্রিসভার অন্যরা নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন! তবে আমি অবাক হচ্ছি, উনি শতভাগ না বলে ৯০ শতাংশ কেন বললেন?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জেনেভা থেকে ভিডিও সংযোগে যুক্ত হয়ে আনিসুল হক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার রিপোর্টগুলো আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। দেখলাম তিনি বলেছেন; কানাডা ও স্লোভাকিয়া বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়াম—এরা সবাই আমাদের অগ্রগতির প্রশংসা করেছে।
প্যালেস দ্য নেশনস–এর দ্য হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড অ্যালায়েন্স অব সিভিলাইজেশনস রুমে পর্যালোচনা অধিবেশনের পুরোটা সময় আমি ছিলাম। আমি ভুল শুনেছি কি না, তা যাচাইয়ের জন্য জাতিসংঘের ওয়েব টিভিতে থাকা অনুষ্ঠানের ভিডিও আবারও শুনলাম। কানাডার প্রতিনিধি মিস ওয়ালেসকা রিভেরার মুখে কোনো সমালোচনা আমি শুনতে পেলাম না। আপনারাও শুনে দেখতে পারেন।
স্লোভাকিয়ার দুসান মাতুলের বক্তব্যের শুরুতে তাদের উদ্বেগের কথা আছে, সুপারিশগুলোও সরকারের পছন্দ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাকে সমালোচনা বললে অন্য যে দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একই রকম সুপারিশ করেছেন, সেগুলোকে কী বলা যাবে?
কূটনীতির ভাষায় প্রশংসা ও সমালোচনা রাজনীতির মাঠের ভাষার থেকে একেবারেই আলাদা। বাংলাদেশ যে জাতিসংঘের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা বা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউর (ইউপিআর) কাঠামোয় অন্যান্য দেশের মতামত শুনতে সম্মত হয়েছে এবং এতে অংশগ্রহণ করেছে, তার জন্য প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়ে মতবিনিময়ে রাজি হওয়ার জন্য পাওয়া ধন্যবাদকে হিসাবে নিলে বলতেই হবে, বাংলাদেশের প্রশংসা লাভের হার এক শতে এক শ।
কূটনীতির ভব্যতা বজায় রেখে অন্যরা বাংলাদেশের যেসব বিষয়ে যা যা করা উচিত বলে মত দিয়েছে বা ‘বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠনমূলক’ যেসব করণীয় সুপারিশ করেছে, সেগুলো প্রকৃত অর্থে কিন্তু আমাদের ঘাটতিগুলো ধরিয়ে দেওয়া এবং তা কাটিয়ে ওঠার পথ বলে দেওয়া। সুতরাং সুপারিশগুলো যদি সমালোচনা হয়, তাহলে সৌদি আরবের প্রতিনিধি মিস সাহাদা আমদি যখন মজুরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে বলেন কিংবা ভারতের ইন্দ্র মনি পাণ্ডে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোয় নজর বাড়াতে বলেন—তাহলে সেগুলো কি সমালোচনা নয়?
স্লোভাকিয়ার দুসান মাতুলে কী বলেছেন? মাতুলে বলেছেন, স্লোভাকিয়া জানে যে বাংলাদেশ মানবাধিকারের অনেক মৌলিক সনদ বা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে (আইনমন্ত্রী তাঁর প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মানবাধিকারের মৌলিক ৯টি সনদের ৮টিতে স্বাক্ষর করেছে)। তবে এগুলোর আইনগত ও প্রায়োগিক বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়।
স্লোভাকিয়া বলেছে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলোয় তারা উদ্বিগ্ন। এগুলো বন্ধ ও তার অর্থবহ তদন্তের জন্য তারা আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের প্রশংসা করে যে ১৯৫১ সালের উদ্বাস্তুবিষয়ক সনদের স্বাক্ষরকারী না হয়েও দেশটি রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে।
স্লোভাকিয়া সুপারিশ করছে—১. সংবাদমাধ্যম যাতে সেন্সরশিপ, শারীরিক হামলার হুমকি ও হত্যার ঝুঁকি থেকে মুক্তভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ; ২. কর্তৃপক্ষের সমালোচনার জন্য সাংবাদিক, আইনজীবী, নাগরিক সমাজের সদস্যরা যাতে যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের শিকার না হন, সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিদ্যমান মামলাগুলো তদন্ত করা; ৩. মৃত্যুদণ্ডের বিলোপ ও সব ফাঁসির আসামির দণ্ড কমিয়ে কারাদণ্ড দেওয়া এবং ৪. জানুয়ারি ২০২৪–এ অনুষ্ঠেয় নির্বাচন যাতে অবাধ ও স্বচ্ছ হয়, তা নিশ্চিত করা।
এসব অপ্রিয় সুপারিশ সরকার যে শুনতে চায় না, তা নতুন কিছু নয়। তবে এ রকম সুপারিশ, যাকে আইনমন্ত্রী সমালোচনা বলে অভিহিত করেছেন, তা আরও কয়েক ডজন দেশের প্রতিনিধি করেছেন।
শুরুতে গত চার বছরে, অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়কালে তৃতীয় ইউপিআরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর পেশ করা রিপোর্টের পর প্রথম বক্তব্য দিয়েছেন রোমানিয়ার মিস মারিয়া মিহাইলেস্কু। মিস মিহাইলেস্কু আইনের শাসনের কথা বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন এবং সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের অধিকার নিশ্চিত করা বলেছেন। তাঁর কথায় অবশ্য স্লোভাকিয়ার মতো নির্বাচন আর গুমের কথা ছিল না।
একইভাবে বেলজিয়ামের প্রতিনিধিও নির্বাচন ও গুমের কথা না বললেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন সব আইন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ) বৈদেশিক অনুদানবিষয়ক আইন বাতিল অথবা সংশোধনের কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নির্বাচনের কথা বলেছে। কিন্তু আইনমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে এগুলো সমালোচনা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিস কুশারস্কি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রান্তিক, জাতিগত সংখ্যালঘু, আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের আকাঙ্ক্ষায় তাদের পাশে আছে। আমরা সরকারের প্রতি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোর পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানাই, যাতে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থাকে।
তিনি বলেন, সহযোগিতার মনোভাব থেকে বাংলাদেশের প্রতি আমরা সুপারিশ করি—১. নাগরিকদের অবাধে ভোট দিয়ে পছন্দমতো সরকার গঠনের অধিকারের সুরক্ষা দিতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তা নিশ্চিত করা; ২. সাংবাদিক, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার রক্ষাকর্মী ও অন্যদের মতপ্রকাশ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার চর্চার জন্য যেন মামলা ও গ্রেপ্তার করা না হয় এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের অবাধে মামলা মোকাবিলার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং ৩. মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য ও অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং যারা তা করছে, তাদের জবাবদিহির জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের মতোই পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন ও চিন্তার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহির ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ফ্রান্স চলমান প্রতিবাদ বিক্ষোভে শ্রম অধিকারের বিষয় সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তার সুপারিশে গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকারকর্মীদের সুরক্ষা এবং নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধে আইন সংশোধনের আহ্বান জানায়।
ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়ার মতো ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেমন গুমবিরোধী সনদ স্বাক্ষরের আহ্বান ও গুমের অভিযোগ তদন্তের কথা বলেছে, তেমনি এই আহ্বান এসেছে বেশ কয়েকটি অ-ইউরোপীয় দেশ থেকে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—সিয়েরা লিওন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, নাইজার ও প্যারাগুয়ে।
ডেনমার্ক আগের ইউপিআরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অগ্রগতি না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি বন্ধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, সাইবার আইন সংশোধন, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ, নারী নির্যাতন বন্ধে আইন সংস্কারের বিষয়গুলোর প্রায় প্রতিটিতে ডজনখানেক করে দেশের সুপারিশ রয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছে যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে। লুক্সেমবার্গও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিক্ষোভকারীদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলেছে।
১১০টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে বরাদ্দকৃত মাত্র ১ মিনিট ৫ সেকেন্ডে এসব সুপারিশ পেশ করার পর সমালোচনা কিংবা প্রশংসার সুযোগ তাঁদের আর কতটা থাকে? ইউপিআর যেহেতু কোনো শুনানি নয়, একটি পর্যালোচনা সভা, সেহেতু সেখানে আইনমন্ত্রীকে কোনো জেরার মুখে পড়তে হয়নি কথাটার মর্ম বোঝা মুশকিল।
বিপরীতে আইনমন্ত্রী মোট চারবারে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় নিয়ে যে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেছেন, সেগুলোয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে ভাষ্য ছিল, তা নির্বাচনী প্রচারের অংশ ছিল কি না, তা নিয়ে ধন্দে আছি।
তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধীদের সব রকম অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং বিরোধী দল পার্লামেন্টে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলন হলে দেশের ভেতরে তাঁর প্রতিপক্ষদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ইউপিআরে অংশ নেওয়া এতগুলো দেশের কাছ থেকে কি ভিন্নমত প্রকাশ ও আইনের শাসনের গ্যারান্টির কথা শুনতে হতো?
(১৬ নভেম্বর ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন