আমরা জানি, ২ নভেম্বর একাদশ সংসদের সমাপণী অধিবেশন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। বহুল বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীতেও বলা আছে, সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২৯ জানুয়ারি। সেই হিসাবেও নির্বাচনের ৯০ দিন গণনা শুরু হয়ে গেছে নভেম্বরের শুরুতেই। এর অর্থ হচ্ছে এ সময়ে সরকারের রুটিন কাজের বাইরে সবকিছু কার্যত নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় চলার কথা।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছে, ’নির্বাচন কমিশনকে তার কার্য সম্পাদনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা সংবিধানের অন্য কোনো বিধান বা অন্য কোনো আইনের ওপর নির্ভরশীল নয়। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, নভেম্বরে সরকার যেভাবে বিরোধী দল বিএনপিকে দমনে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে ইসির ভূমিকা কী? ইসিকে তাই স্পষ্ট করতে হবে, তারা বিরোধীদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে নির্বাহী শাখাকে বলেছে কি না। ৪ নভেম্বরের সংলাপের আগে ইসি কি বিরোধী দল বিএনপি যাতে তাদের দলীয় রীতি ও নীতি অনুযায়ী সংলাপে যোগদানের বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে রকম পরিবেশ তৈরির জন্য পুলিশ ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিল?
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে উদ্যোগ নিতে দলগুলোর প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সর্বশেষ আবেদন আসলে কৌতুক কি না, বোঝা মুশকিল। বিএনপির জনশূন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালাবদ্ধ গেটের পেছনে একটি খালি চেয়ারে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিয়ে ইসির দায়িত্ব সম্পন্ন করার কারণেই এমন সংশয়। অবশ্য দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট সত্যিই যে বিদ্যমান, সিইসির এই স্বীকারোক্তি গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের এ সংকট সমাধানের ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট নেই দাবিটি অবশ্য অনেকের চোখেই ইসির কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কমিশন যখন এটি বিশ্বাস করে যে এমন একটি সংকট রয়েছে যাতে অবাধ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন নিশ্চিত করা অসম্ভব, তাহলে তার সমাধান ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠান কীভাবে ন্যায্যতা পেতে পারে?
বিএনপির আটক শীর্ষ নেতারা যেসব মামলায় আটক হয়েছেন সেগুলো যে জামিনযোগ্য নয়, ব্যাপারটা এমন নয়। তাহলে তাদের জামিন না হয়ে বন্দিত্ব দীর্ঘায়িত করা এবং উল্টো দীর্ঘতর রিমান্ডের ব্যাখ্যা কী? এখন তো সরকারের রুটিন কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার কথা। একই সঙ্গে নির্বাচনের সুষ্ঠু ও অবাধ প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষুন্ন হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার কথা। আমরা কি তাহলে ধরে নেব যে ইসি হয় সরকারকে সহয়োগিতা করছে, নয়তো সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি থেকে নিবৃত্ত রাখতে অক্ষম? এতে কি প্রমাণ হয় না যে ইসি পক্ষপাতদুষ্ট এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে অক্ষম?
ক্ষমতাসীন দলের সংবিধানের অধীনে নির্বাচনের মন্ত্রটি এখন এমন এক অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের একজন ফারুক খান, যিনি ইসির আলোচনায় তার দলের প্রতিনিধিত্ব্ করেছেন, তিনি এখন সংবিধানের এক নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। ফারুক খান বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই হবে, সংবিধানে এমন কিছু নেই। তার বক্তব্য আক্ষরিক অর্থে সত্য হতে পারে, কিন্তু তাঁকে পাল্টা প্রশ্নও করা যায় যে সংবিধানে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা কিম্বা ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নই শেষ কথা, এমন বিধান কোথায় আছে?
অদ্ভুত শোনালেও সত্য হচ্ছে, আমাদের নির্বাচনী আইনে নির্বাচনের কোনো পূর্ণাঙ্গ আইনি সংজ্ঞা নেই। একমাত্র সংজ্ঞা পাওয়া যাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর ধারা ২(৭) ধারায়, যেখানে বলা হয়েছে, "’নির্বাচন’ অর্থ এই আদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত সদস্যের একটি আসনে নির্বাচন।” গত ৫০ বছরে, এই আইনটি বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু এই অসম্পূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত সংজ্ঞা অপরিবর্তিত রয়েছে। সম্ভবত রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় থাকার সময় যাতে সুবিধামত ব্যাখ্যা করার সুযোগ পান তার জন্যই এটির সংজ্ঞায়নের কথা তাঁরা ভাবেননি।
তবে নির্বাচনের বিষয়ে আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত যে সংজ্ঞা আছে, তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতাও অনস্বীকার্য। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদের ( আইসিসিপিআর) স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশের এ বাধ্যবাধকতা মেনে চলার কথা। আইসিসিপিআর-এর অনুচ্ছেদ ২৫ একটি প্রকৃত নির্বাচনের সুস্পষ্ট শর্ত দিয়ে বলেছে, “ অনুচ্ছেদ ২-এ বর্ণিত কোনো বৈষম্য এবং অযৌক্তিক বিধিনিষেধ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার এবং সুযোগ থাকবে – যা হবে সর্বজনীন এবং সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এবং গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। এ ছাড়া এতে নির্বাচকদের ইচ্ছার অবাধ অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা হবে।”
এখন যেহেতু ইসি স্বীকার করছে, নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে বিরোধের কারণে সংকট আছে এবং তা কমিশনের বদলে দলগুলোর সমাধান করা উচিত, সেরকম অবস্থায় বিরোধে জড়িত কোনও পক্ষ যদি তা বয়কট করে তাহলে তার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। এর পাশাপাশি আছে বর্তমান ইসির বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা। বর্তমান ইসির অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তার প্রায় সবগুলোই ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দলীয় ( মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বিদ্রোহীর মধ্যে) প্রতিদ্বন্দ্বীতা, যাতে ভোটারদের পছন্দের সুযোগ ছিল না। আর, মুষ্টিমেয় যে কটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যরা ছিল – যেমন রংপুর ও কুমিল্লার মেয়র নির্বাচন বা গাইবান্ধার উপনির্বাচন, সেসব জায়গায় ইসি সমসুযোগ এবং সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা মূলত নির্বাহী বিভাগের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব কার্যকর করতে না পারার।
২০০৮ সালের আগেই নির্বাচন প্রশ্নে যেসব সংস্কার হয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশন যে আইনগতভাবে পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যখন এ ক্ষমতার পক্ষপাতমূলক প্রয়োগ ঘটে তখন প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত না হয়ে পারে না। চলমান সংকট মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কমিশনের যে ভূমিকা তা মোটেও আশার সঞ্চার করে না। নির্বাহী বিভাগের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা কার্যত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের অসারতাই কি প্রমাণ করে না? স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালে এমন সংকটের কারণেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের দাবির মুখেই এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।
(৮ নভেম্বর, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন