সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সরকার কি আসলেই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনছে?

 


নির্বাচনকে ঘিরে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'এসব নিয়ে আমরা বিচলিত নই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের পরেও বিভিন্ন রকমের চাপ আসতে পারে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির অশুভ পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে।’ ৯ ডিসেম্বর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের একথা বলেন। এর আগে, ৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বলেন – আগামী বছরের মার্চের দিকে দেশে ‘‌দুর্ভিক্ষ ঘটানোর’ দেশী-বিদেশী পরিকল্পনা রয়েছে। তাঁর বক্তব্যটি যে গুরুতর উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে দেশে যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে পড়েছে। 


সরকার যেখানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না, তখন এরকম উদ্বেগজনক সম্ভাবনার কথা তথ্যভিত্তিক না হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। শুধু নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে তাল মিলিয়ে বিপর্যস্ত বিএনপি দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাতে পারে – এমন দাবি রাজনৈতিক প্রচারে সুবিধা দিলেও তা খুবই বিপজ্জনক একটি কৌশল। নির্বাচন নিয়ে সরকার যতটুকু বিদেশি চাপের মুখোমুখি হয়েছে, তা প্রধানত এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ১১ ডিসেম্বর বলেছেন,নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই কমেছে। 


অবশ্য ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা গত সপ্তাহখানেক ধরে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কার কথা বলে চলেছেন। তাঁরা একই সঙ্গে এটাও দাবি করছেন যে নিষেধাজ্ঞা আসলে তা হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অর্থাৎ, তার জন্য ব্যবসায়ীদের কোনো দায় নেই। তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মতো মজুরি ও শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করায় ও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নতুন শ্রমনীতি ঘোষণার পর অনেকেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পোশাক খাতের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন দাবি করছে যে তারা এমন কিছু করেনি, যা নিষেধাজ্ঞার কারণ হতে পারে। তারা তাই রাজনীতির সংকটের প্রতি আঙ্গুল তুলেছে। 


সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি কিছটা ধোঁয়াশাপূর্ণ হওয়ায় সংশয় বেড়েছে বৈ কমে নি। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের কাছে কি অর্থনীতির এমন কোনো অপ্রকাশিত তথ্য–উপাত্ত আছে যার ওপর নির্ভর করে তারা দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে? পাশাপাশি মানুষকে কঠিন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করতে আগে থেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে? সংবাদমাধ্যমে এখন যেসব খবর প্রায় নিয়মিত হয়ে গেছে, তার মধ্যে আছে ডলার সংকট, বিপুল খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের তারল্য সংকট এবং বাজারে কোনো না কোনো নিত্যব্যবহার্য পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ে কারসাজি। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কথিত সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি ও অতি মুনাফার উপদ্রব যে জনজীবনে ভোগান্তির কারণ হচ্ছে, তা–ও অজানা কিছু নয়।   



আমরা জানি, আমাদের প্রায় সব খাদ্যপণ্যই এখন আংশিকভাবে  আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ স্থানীয় উৎপাদনে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। যদিও বড় ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা ফসলহানির মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু চালের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে আটা, ভোজ্যতেল, ডাল, চিনির দাম। তারপর দেখা গেছে, আলু, গোমাংস ও ডিমের সংকট। এখন আবার দ্বিতীয় দফায় শুরু হয়েছে পেঁয়াজের দামে অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতি। এসব পণ্যের ঘাটতি সামাল দিতে সরকারকে শেষ পর্যন্ত আমদানির পথে যেতে হয়েছে। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এ,গুলোর ক্ষেত্রে কি ডলার সংকটের কোনো ভূমিকা আছে? 


ব্যবসায়ীরা যদি সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কোনো আগাম খবর না পেয়ে থাকে, অথবা সরকারকে যদি আগাম সতর্ক না করা হয়ে থাকে, তাহলে দুর্ভিক্ষের আলাপ কেন? অন্য আরেকটি বিপত্তির উৎস হতে পারতো আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), যদি তারা প্রতিশ্রুত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় না করার কথা জানিয়ে দিত। কিন্তু আইএমএ’র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা বলেছেন যে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হচ্ছে বলে তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন। সেই আশ্বাস যথার্থ না হলে এবং আইএমএফের কিস্তি আটকে গেলে তার প্রভাব ঋণের অন্যান্য উৎসের ওপরও পড়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু কিস্তি ছাড় হয়েছে। তাহলে কেন দূর্ভিক্ষের কথা? সংশয় দূর করার জন্য তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুতই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি কোত্থেকে, কতটা জোরালো আওয়াজে তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন, তা খোলাসা করা। 


দুর্ভিক্ষ কেন হয়, দীর্ঘ  গবেষণার ভিত্তিতে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার নামে বেশি পরিচিত পুরস্কার পাওয়া বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বাংলার দুটো দুর্ভিক্ষ – ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর এবং ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – তাঁর গবেষণার অংশ ছিল। তাতে তিনি দেখিয়েছেন চাহিদার তুলনায় মোট কতটা  খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটা দুর্ভিক্ষের কারণ নয়। উৎপাদন আগের তুলনায় বাড়লেও অর্থাৎ খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। বাংলার দুই দুর্ভিক্ষই হয়েছে মূলত: খাদ্য বিতরণব্যবস্থায় সংকটের কারণে। 


অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, উভয় দুর্ভিক্ষেই খাদ্য সংকটের ঝাপটা নগরাঞ্চলের মানুষের ওপর দিয়ে যায়নি, বরং গ্রামাঞ্চলেই তার রুপ ছিল ভয়াবহ। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে কোলকাতায় না খেয়ে মানুষ মরেনি, মরেছে গ্রামাঞ্চলে। ১৯৭৪ সালেও বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের মানুষের জন্য রেশনে চাল–গম দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, যা গ্রামে ছিল না। এ কারণে প্রায় যে দশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই গরিব এবং জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষ। অবশ্য কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য শুরুর শাস্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার খাদ্য সাহায্য স্থগিত করায় সংকটের মাত্রা যে বেড়ে গিয়েছিল, সে কথাও তাঁর রচনায় উল্লেখ রয়েছে।  


কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কখনো কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল দুর্ভিক্ষের কারণ হয়েছে, এমন নজির পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক বিরোধ তখনই দুর্ভিক্ষের কারণ হয় যখন তা সংঘাতের রুপ নেয়। অন্য কথায়, গৃহযুদ্ধ ঘটলে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন না ঘটলে খাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। খাদ্যের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার মাইকেল ফাখরি গত ৯ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে তাঁর পেশ করা রিপোর্টেও বলেছেন, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ খাদ্য ঘাটতির কারণে ঘটে না। বরং, তা ঘটে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থতার কারণে। আমরা কি তাহলে ধরে নেব যে একতরফা নির্বাচন হতে চলেছে, তার কারণে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের সব সম্ভাবনা নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে? তার পরিণতিতেই কি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা?


( ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...