সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের নির্বাচন তুলনীয় নয়

 আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ২৮ জানুয়ারি আমাদের জানিয়েছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত আমাদের পাশে জোরালোভাবে দাঁড়িয়েছে। এটা খুব জরুরি ছিল, যা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। কারণ, কোনো কোনো বিরোধী দল কোনো বিদেশি শক্তির সঙ্গে মিলে নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল। নির্বাচনের আগে অবশ্য ভারতের তরফ থেকে প্রকাশ্যে খুব বেশি কিছু বলা হয়নি। নির্বাচনকে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করলেও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা বলতে ভোলে নি। 


ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মার সঙ্গে ২৮ জানুয়ারির বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদেরের কথা থেকে নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে ভারত শুধু সক্রিয় ভূমিকাই রাখেনি, তা জোরালো ছিল এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ’জরুরি’ ছিল। দেশ রুপান্তর পত্রিকার খবর অনুযায়ী ওবায়দুল কাদের বলেন, বৈঠকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, ভারতের আর আমাদের রাজনীতির মধ্যে অভিন্নতা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করে উন্নয়নের রাজনীতিই আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য।


একই পত্রিকা গত ৭ ফেব্রুয়ারি জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর থেকে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, এবারের নির্বাচন সব থেকে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তাঁর এ মন্তব্য থেকে আমরা যা বুঝতে পারি, তা হচ্ছে এর আগে যে নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী হয়ে তিনি সরকার গঠন করেছেন, সেগুলোকেও তিনি এবারের নির্বাচনের তুলনায় ততটা অবাধ ও সুষ্ঠূ মনে করেন না। ২০০৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন দুটি নিয়ে বিএনপির নানারকম অভিযোগ থাকলেও দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সেগুলোকে সুষ্ঠূ ও অবাধ বলেই রায় দিয়েছেন। 


আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের পর দেশের দুটি জাতীয় নির্বাচন ছাড়া বাকি সব ক’টি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। সামরিক সরকারের আমলে হয়েছে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আর বাকিগুলো ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর। যে দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি, তার একটি হচ্ছে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন এবং অপরটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বর্জন করা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ করার পর তিনটি নির্বাচন হয়েছে সেই ব্যবস্থায়, যার দুটিতে আওয়ামী লীগ ও একটিতে বিএনপি বিজয়ী হয়। এরপর আওয়ামী লীগ তত্ব্বাধায়ক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে নির্বাচন করেছে তিনটি। 


প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কথায় অবশ্য দেখা যাচ্ছে, তিনি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই। ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি নির্দ্বিধায় বলেছি, যদি নির্বাচনটা আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক হতো, তাহলে ভোটার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে আরও বেশি হতো। তাঁর কথায়, ’বড় বড় রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচন অশুদ্ধ হবে না’ নির্বাচন অবৈধ হবে না; কিন্তু নির্বাচনের যে সর্বজনীনতা সেটা খর্ব হতে পারে, গ্রহণযোগ্যতা খর্ব হতে পারে, নির্বাচনের যে ন্যায্যতা সেটাও খর্ব হতে পারে। লিগ্যালিটি নিয়ে হয়তো প্রশ্ন হবে না। কিন্তু লিগ্যালিটির সঙ্গে লেজিটিমেসির যে সম্পর্ক আছে সেটাকে টোটালি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ 


প্রধান নির্বাচন কমিশনার শুধু এটুকু বলেই থামেন নি, তিনি পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে পাকিস্তানে সাড়া জাগানো-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে। তিনি যে নির্বাচন পরিচালনা করলেন, সেই নির্বাচনের ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য তাঁকে হয়তো ধন্যবাদ দেওয়া যায়, কিন্তু ব্যর্থতার দায়মুক্তি তিনি যে কোনোভাবেই পেতে পারেন না, সেকথার পুনরাবৃত্তি করতেই হয়। 


পাকিস্তানের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা অবশ্য শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালই করেছেন, তা নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেও তুলনা টেনেছেন। তাঁদের কাছে পাকিস্তানের পািটিআই দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মহানায়কের চেয়ে কম কিছু নন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নানারকম নির্যাতন–নিপীড়ণের মধ্যেও তিনি তাঁর দলকে নির্বাচনী লড়াইতে রেখেছেন। তাঁর অনুসারীরা দল হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে চমক দেখানো সাফল্য দেখিয়েছেন। 


এসব বিশ্লেষকদের বক্তব্য, যেকোনো মূল্যে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে ইমরানের পিটিআইয়ের মতো সাফল্য বিএনপির কাছেও ধরা দিত। এমন সরল ভাবনার সমস্যা হলো, তাঁরা ভুলে গেছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাটি নির্বাচন হয়েছিল এবং বিএনপি সে নির্বাচনে গ্রেপ্তার, গুম, মামলা–হামলা সত্ত্বেও অংশ নিয়েছিল। অর্থাৎ, পাকিস্তানে পিটিআই ২০২৪ সালে যা করেছে, বিএনপি সেই চেষ্টা পাঁচ বছর আগেই করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৮ সালে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে। তখনো নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য বিদেশিদের আগ্রহ ও চাপ কম ছিল না।


এবার ক্ষমতাসীন দল ও সরকার যেসব কৌশল অনুসরণ করেছিল, তার সবই সংবাদমাধ্যমে কমবেশি প্রকাশ পেয়েছে। যারা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারে, শুধু তারা নয়, প্রতিটি আসনে তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিকল্প নেতাদেরও পুরোনো মামলা, গায়েবি মামলা অথবা সন্দেহজনক নাশকতার  অজুহাতে গ্রেপ্তার অথবা এলাকাছাড়া করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া নেতারা জামিন আবেদনের শুনানিরও সুযোগ পান নি। নির্বাচনের একমাস পরও শীর্ষ নেতাদের জামিন হয়নি, বরং নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একই ঘটনার কারণে একাধিক থানায় একাধিক মামলা দায়েরের চর্চাও এক নতুন সংযোজন। দলটির দাবি অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা ২০ হাজার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে ঢালাওভাবে আটকের তথ্য নাকচ করা যায় না।  


পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক–সামাজিক দুর্গতির জন্য সেখানকার সামরিক বাহিনীর অদৃশ্য ক্ষমতা ও অস্বাভািবক প্রভাবকে দায়ী করা হয়। এমনকি নির্বাচনের জন্য তারা যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছে, সেই সরকারও সামরিক বাহিনীর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। নির্বাচনে স্বত:স্ফূর্ত  অংশগ্রহণে সেখানে ভোটারদের  কেউ বাধা দেয় নি বলে ইমরানের পিটিআই চমক দেখাতে পেরেছে। অর্থনীতি ও সামাজিক অগগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তান আমাদের থেকে যে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্যের পর এখন যদি কেউ বলেন যে নির্বাচনের গতিপথ ও ফল নিয়ন্ত্রণেও তাদের আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, তাহলে কি তা ভুল হবে?  


(১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।) 







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...