সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

উপমহাদেশে নির্বাচনে আমরা কেন আলাদা

 বলা হচ্ছে, ২০২৪ সাল বিশ্বের নির্বাচনের বছর। ইতিহাসে আর কোনো বছরে এত বেশিসংখ্যক দেশে এত বেশিসংখ্যক ভোটার এর আগে কখনো ভোট দেয়নি। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৬৪টি দেশে চলতি বছরেই নির্বাচন হচ্ছে। টাইম সাময়িকীর হিসাবে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশের এ বছরে ভোট দেওয়ার কথা। পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন এরই মধ্যে হয়ে গেছে। ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনের বিষয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু বছরের শুরুতেই নির্বাচন নিয়ে উপমহাদেশে যেসব নাটকীয় নজির তৈরি হয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর প্রভাব ভবিষ্যতেও অনুভূত হবে। 


পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সেখানেও নির্বাচনে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দল ইমরান খানের পিটিআইকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ–পিপিপি জোটের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে তারা ভোটারদের ভোট দেওয়ায় বাধা দেয়নি। ভোটাররা দল ও দলের প্রতীকবঞ্চিত পিটিআইয়ের প্রার্থীদের নিরাশ করেনি। ফলে পিটিআইকে ঠেকাতে ভোট গণনায় কারচুপির আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখন একটু একটু করে সত্য প্রকাশ পাচ্ছে, পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠছে। 


পাকিস্তানে ভোট গণনায় কারচুপির তথ্য ফাঁস হয়েছে নাটকীয়ভাবে। পিটিআই প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয়ী ঘোষিত একজন প্রার্থী জানিয়েছেন, তিনি জেতেন নি, তাঁকে বিজয়ী দেখানো হয়েছে। রাজনীতিকেরা যেখানে ক্ষমতার জন্য ব্যকুল থাকেন, সেখানে এমন নজির অকল্পনীয়। এরপরের নাটকীয়তা দেখা গেছে রাওয়ালপিন্ডির কমিশনারের পদত্যাগ এবং রিটার্নিং অফিসারদের ফল পাল্টে দেওয়ার তথ্য প্রকাশের ঘটনায়। আমলাদের মধ্যে কেউ এমন ঝুঁকি নেওয়া মোটেও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। রাওয়ালপিন্ডির বিভাগীয় কমিশনার লিয়াকত আলি চাথা তাঁর এখতিয়ারভুক্ত গ্যারিসন সিটির ১৩টি আসনের ফল নিয়ে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা বলে তিনি রাজনৈতিক চমক তৈরির চেষ্টা করেছেন বলে সরকারের তরফ থেকে পাল্টা অভিযোগ করা হয়েছে। দীর্ঘ চাকরি জীবনের অর্জিত সব আর্থিক সুবিধা হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কেউ রাজনৈতিক চমক তৈরির চেষ্টা করবে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। 


পাকিস্তানে সম্পর্কে সমালোচনার অন্ত নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে নিন্দনীয় হচ্ছে, তাদের সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে খবরদারি। দেশটি নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকেও আমাদের থেকে পিছিয়ে। কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়ার পবিত্রতা রক্ষার মূল্য যে এখনও সবাই বিস্মৃত হয়নি, সেটা নি:সন্দেহে ইতিবাচক এবং গুরুত্বপূর্ণ । 


পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে, তা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের পরে। কিন্তু ভারতে যা ঘটেছে, তা হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই। আর এতে মূল ভূমিকাটি উচ্চ আদালতের। পাঞ্জাবের চন্ডিগড়ের মেয়র নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের ব্যালট কারসাজির ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপিকে জেতানোর জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা আটটি ব্যালট বিকৃত করে তা বাতিল ঘোষণা করেন, যার ফলে আম আদমি পার্টির (এএপি) প্রার্থীর বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে বিজেপি প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার ব্যালট বিকৃতির বিষয়টি ভিডিওতে ধরা পড়ায় আদালতে তিনি রেহাই পাননি। 

 

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট এএপি প্রার্থীর আবেদনের শুনানি করে আদালতে ব্যালট নিয়ে এসে তা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং আদালতেই পুর্ণগণনা করে ঘোষিত ফল বাতিল করেছেন। কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র নির্বাচনের বিধান থাকায় ব্যালটসংখ্যা ছিল কম এবং সেকারণে আদালতে এগুলো পরীক্ষা করা ও পুর্ণগণনায় তেমন সমস্যা হয় নি। তবে এ ঘটনায় ব্যালট পুর্নগণনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শুধু ফল বাতিল করা নয়, নতুন নির্বাচনের জন্য বিজেপির দাবি অগ্রাহ্য করে ওই ভোটের ভিত্তিতেই আবেদনকারী এএপি প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা। 


বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় বিজেপি বুঝতে পারে যে তাদের বিজয় টিকবে না এবং সেকারণে শুরু হয় কাউন্সিলর কেনার পালা। এএপির তিনজন কাউন্সিলরকে বিজেপি দলে টেনে নিয়ে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যেন পুর্ননির্বাচনে তারাই জয়ী হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা হতে দেয়নি। প্রধান বিচারপতি বলেন, এই আদালতের "কর্তব্য এটি নিশ্চিত করা যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি যেন কোনো অপব্যবহারকারী দ্বারা নস্যাৎ না হয়"। আদালত বলেন, তাই আমরা মনে করি যে মৌলিক গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নিশ্চিত করার জন্য এমন ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে আদালতকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।


ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে নানারকম হয়রানি ও তদন্ত এবং দল ভাঙ্গাভাঙ্গির কৌশল অনুসরণ করে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে এবং বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করছে, তাতে সাধারণভাবে ধারণা তৈরি হচ্ছে যে তাদের পুর্ননির্বাচন প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু চন্ডিগড়ে বিজেপির কৌশল আদালতের কারণে ভেস্তে গেছে। একইভাবে সুপ্রিম কোর্ট গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন নিয়েও একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিজেপি। রাজনৈতিক দলকে বেনামে আর্থিক অনুদান দেয়ার জন্য আইনি সুবিধা 'নির্বাচনী বন্ড'কে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছেন এবং কোন দল কার কাছ থেকে কত টাকা এসব বন্ডের মাধ্যমে পেয়েছে, তার হিসাব প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন।   

 

বছরের শুরুতেই বাংলাদেশেও বয়কটপীড়িত একটি একতরফা নির্বাচন হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বদলে এটি ’ডামি নির্বাচন’ বিশেষণে পরিচিতি পেয়েছে যতটা না বিরোধী দলের কারণে, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাসীন দলের ডামি প্রার্থী দেওয়ার কারণে। বলা হচ্ছে, নতুন সংসদের এক পঞ্চমাংশ সদস্য আসলে ছিলেন ডামি প্রার্থী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা নির্বাচনী লড়াইয়ে না থাকলেও ক্ষমতাসীন জোটের যেসব নেতা হেরে গেছেন, তাঁরা  ’ভোট–ডাকাতি’,’ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’, ’আগের রাতে ভোট’, ’কারচুপি’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। 


প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্বীকার করেছেন যে নির্বাচনে মানুষের আস্থা কমে গেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নির্বাচন ব্যবস্থায় আস্থা নষ্ট হওয়ার ঘটনা যে এবারই প্রথম, তা–ও নয়। এর আগেও দুটি নির্বাচনে মানুষ ভোটের সুযোগ পায়নি। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও পবিত্রতা রক্ষার নৈতিক দায় নিতে আমাদের দেশে  কেউ প্রস্তুত বলে মনে হয় না। আমাদের আদালতেও কোনো নজির তৈরি হয় না। উপমহাদেশে নির্বাচন নিয়ে যত নাটকীয়তাই ঘটুক না কেন, অন্যরা অন্তত ভোটের পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা করছে। আর আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...