এর আগের লেখায় আমি একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন কেন এবং কীভাবে রাজনৈতিক রুপ পেল, তা নিয়ে যখন লিখেছিলাম, তখন কল্পনাও করিনিলেখাটি ছাপার আগেই নিহতের সংখ্যা এক লাফে ২৭ হয়ে যাবে। বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল রংপুরের যে আবু সাঈদ, তাঁর খুন হওয়ার দিনে দেশের আরও দুটি জায়গা মিলিয়ে মোট ৬ জন নিহত হওয়ায় আমি লিখেছিলাম, দেশে কোনো ছাত্র আন্দোলনে একদিনে এতজনের প্রাণহানির রেকর্ড আর নেই। লেখাটা ছাপা হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগেই ১৮ জুলাই ২৭ জনের প্রাণহানির খবর অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। তারপর তা আরও কয়েকগুণ বেড়ে, বেসরকারি হিসাব ২০০ ছাড়িয়েছে, যে সংখ্যা আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ অবসানের পর আর কোনো আন্দোলন দমনে ঘটেনি।
একটু খোঁজ–খবর করে দেখলাম, শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের গণ–অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা ছিল ১০। বেলারুশে স্বৈরশাসক লুকাশেঙ্কো গণবিক্ষোভ দমনে যে শক্তিপ্রয়োগ করেছিল, তাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৬। পাকিস্তানে শাহবাজ সরকারের বিরুদ্ধে পিটিআইয়ের আন্দোলনেও নিহতের সংখ্যা ডজনখানেকের বেশি নয়। সবচেয়ে বেশি রক্তপাতের রেকর্ডটি হচ্ছে মিশরের ক্ষমতাচ্যূত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের। ২০১১ সালের সেই গণ–অর্ভূত্থানে ৮৪৬ জন মৃত্যুবরণ করে। আমাদের অবস্থানটি তাহলে কোথায় দাঁড়ায়?
এত মৃত্যু, এত হাহাকার আর আর এত ক্ষোভের মধ্যে গত কয়েক দিনে সাদাচোখে যা ধরা পড়েছে, তার অনেককিছুই আমরা আমাদের জীবদ্দশায় দেখিনি। তাই প্রাথমিকভাবে কিছু জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। পুরো ছবি পরিষ্কার হলে আরও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে। ক্ষমতাসীন সরকার, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং আমরা যারা সাধারণ নাগরিক – তাদের সবারই আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের বিপুল অংশগ্রহণ। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের চেয়েও এ আন্দোলনে স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। ২০১৮ সালের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও তা ছিল অনেকটাই ঢাকাকেন্দ্রিক। এবার এর বিস্তৃতি কার্যত দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে গেয়িছেল। এবার এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কেন এবং কীভাবে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা আন্দোলন গড়ে তুলল?
ছাত্রীদের অংশগ্রহণের দিক থেকেও এটি নজিরবিহীন। এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রীর অংশগ্রহণ, বিশেষ করে রাজপথে নেমে আসা এবং ছাত্রলীগ পরিচয়ে বাধাদানকারীদের ভয়ভীতি মোকাবিলা করায় তারা অভূতপূর্ব সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছে। সরকারি চাকরি বা রাষ্ট্রীয় সুবিধায় বৈষম্যমুক্তির জন্য ছাত্রীদের এই আকুতি আমরা কীভাবে দেখব? অনগ্রসর অবস্থান থেকে সমতায় উঠে আসার জন্য যে নারী কোটা ছিল, তার অবসান তারা কীভাবে নেবে?
কথিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি দীর্ঘদিনের একটি অনুষঙ্গ। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য তৈরি করে। ছাত্রলীগের একক আধিপত্যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গত এক দশকেরও বেশি সময় অসহায়ত্বের শিকার হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল। এই আন্দোলনে ক্যাম্পাসগুলোকে ছাত্রলীগমুক্ত করতে চাওয়ার পেছনে সেটাই কি মূল কারণ? অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনে ক্যাম্পাস থেকে রাজনৈতিক দলের লেজুড় সংগঠনকে বহিষ্কারের যে নজির বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে, সেটা কি একটা মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে? ছাত্রলীগের প্রতি তরুণদের এই ক্ষোভ কি তাদের পৃষ্ঠপোষক দল বিবেচনায় নিচ্ছে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা এত দিন একেবারেই রাজনীতিবিমুখ ছিল বলে ধারণা করা হতো। উচ্চবিত্ত কিম্বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই যেহেতু মূলত সেখানে ভর্তি হয়, তাই আপেক্ষিক স্বচ্ছ্বলতার কারণে অন্যদের সমস্যা বা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে নির্বিকার থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এবার সেই ধারণা তারা ভেঙ্গে দিয়েছে। সম্ভবত আন্দোলন দমনে পুলিশ সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও তার আশপাশে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন ব্যবস্থা নেই, ফলে তাদের মেলামেশা, সংগঠিত হওয়ার সুবিধাও সীমিত। তারপরও কেন তারা এত বিপুলসংখ্যায় মিছিলে নেমে এসেছে?
শিক্ষার্থীদের দমনে সরকার যতই কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তারাও ততই অনড় থেকেছে। আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাংগঠনিক দক্ষতা অনেক রাজনৈতিক দলকেই লজ্জা দেওয়ার মতো। এর কারণ কি শুধুই প্রযুক্তি? হাতের মুঠোফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নাকি বিক্ষোভের তীব্রতাই তাদের সাহস তৈরি করেছে ও সাংগঠনিক সাফল্য এনে দিয়েছে?
ছাত্রলীগের হামলা ও হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা–ও নজিরবিহীন। সরকারের বিরুদ্ধে নানাকারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর ১৫ বছরের একটানা শাসনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে, সেটা কোনো রাজনীতিকেরই না জানার কথা নয়।
আন্দোলনকারীদের ছাত্র ও অছাত্র হিসাবে বিভাজন করে সেখানে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি আবিষ্কার এবং তাদের বিএনপি–জামাত হিসাবে অভিহিত করার অর্থ হচ্ছে জনঅসন্তোষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। সরকারবিরোধীদের নিবর্তন ও নির্মূলের জন্য অজুহাত হিসাবে তা এর আগেও ব্যবহৃত হয়েছে। এবারও হচ্ছে। কথাটা এখন যে বিদেশিরাও বলছে, তা ইকোনমিস্ট সাময়িকীর সর্বসাম্প্রতিক নিবন্ধেও বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে বিরোধীদলের ওপর দোষ চাপিয়ে কি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের অবসান হবে?
এবারে আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের যে বেপরোয়া ব্যবহার দেখা গেল, তা কোন আইন অনুমোদন করে? ’হাসপাতালে কয়েক হাজার আহত, অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ’ শিরোনামে সমকাল জানিয়েছে, রামপুরা–বাড্ডার শুধু দুটি হাসপাতালেই ১ হাজার ৮০০ আহত চিকিৎসা নিয়েছে। প্রথম আলোর খবরে আমরা জেনেছি, ঘরের ভেতরে বা বারান্দায় থাকা শিশুরা কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বিক্ষোভকারী কাউকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি করা, আহতকে উদ্ধার করতে আসা সঙ্গীকে গুলি করা, আহতকে চিকিৎসার জন্য না পাঠিয়ে তার প্রতি নিষ্ঠূর আচরণ করার মতো যেসব ঘটনার ছবি নেটদুনিয়ায় ভাসছে, তা রোমহর্ষ নিষ্ঠুরতা।
আমাদের পুলিশ যে রাবার বুলেট ব্যবহার করে, তা জাতিসংঘ তাদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করেছে। এর যথেচ্ছ ব্যবহারের আরেক নজির হচ্ছে চক্ষুবিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট হাসপাতালে চোখে আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরিসংখ্যান। সেখানে ৪২৪ জনকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, যার মধ্যে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়েছে ২৭৮ জনের। তারপর একজন মন্ত্রী বলেছেন আন্দোলন দমন করতে চাইলে তা সরকার আধঘন্টায় করতে পারে। গণ–আন্দোলন দমনে এ কেমন কৌশল?
বিপরীতে পুলিশও যে মাত্রায় আক্রমণের শিকার হয়েছে, তা–ও অতীতে কখনো দেখা যায়নি। পুলিশের স্থাপনা আক্রান্ত হওয়া ও জ্বালিয়ে দেওয়ার যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে. তাতে আক্রোশের ছাপ পাওয়া যায়। পুলিশ কেন জন–আক্রোশের লক্ষ্য হলো? আইননিষ্ঠ না হয়ে দলনিষ্ঠ হওয়া, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগগুলো কি একেবারে নাকচ করে দেওয়া যায়? নিষ্ঠূর আচরণ ও রাজনৈতিক পক্ষপাত যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করছে, তা কি তাঁরা বুঝতে পারেননি?
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার বিষয়টি নতুন নয়। বৈশ্বিক মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা যে আফগানিস্তানের থেকেও পিছিঢয়ে পড়েছি, সেটাও সবার জানা। কিন্তু কোনো আন্দোলন দমনের সময়ে তিনজন সাংবাদিকের প্রাণহানি কীভাবে মেনে নেব?
ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে দেশের ভেতরের ১৬ কোটি এবং প্রবাসী এক কোটি মানুষকে শুধু যে তথ্যপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তা নয়, তাদের মৌলিক মানবাধিকারও কি লংঘিত হয়নি? লন্ডনে একজন বাংলাদেশি ডাক্তার অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ায় তাঁর মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি, তাঁর আর ফোন করা হয়নি। সৌদিপ্রবাসী এক বাংলাদেশি মায়ের মৃত্যুর কথা টেলিফোনে জানতে পারলেও শেষবারের মতো তাঁর মুখ দেখতে পারেননি বলে যে আহাজারি করছিলেন ফেসবুকে তার ভিডিও ঘুরতে দেখেছি।
এগুলো কি অমানবিক মানসিক নিপীড়ণ নয়? একে পুরো জনগোষ্ঠীকে সাজা দেওয়ার সমতুল্য গণ্য করা কি অযৌক্তিক হবে?
(২৯ জুলাই, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন