কোটা সংস্কারের ছাত্র আন্দোলন এবং তা থেকে যে গণ–আন্দোলন তৈরি হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় বাংলাদেশ অনেকটাই বদলে গেছে। কোটার রাজনৈতিক অপব্যবহারের মধ্যে যে বৈষম্য তা ছাত্র–তরুণদের মধ্যে ন্যায়–অন্যায়ের বোধকে জাগিয়ে দিয়েছে, অধিকারের প্রশ্নে সচেতন করে তুলেছে এবং তাদের সাহস উসকে দিয়েছে। গত দেড় দশকে গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধন ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা জোরদার হতে থাকায় এসব ভাবনা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। রাষ্ট্রীয় সুবিধার বংশগত বিস্তৃতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনে যে ব্যপক অংশগ্রহণ ও সমর্থন দেখা গেল, তা দেশের রাজনৈতিক আবহেও বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে।
তবে যা বদলায়নি, তা হলো সরকারের আন্দোলনের সবকিছুর জন্য বিরোধীদলকে দায়ী করা এবং তাদের আরও এক দফা জেলে পোরা ও মামলা দিয়ে নাজেহাল করার কৌশল অনুসরণ। এবারও একই কৌশল অনুসৃত হচ্ছে এবং গ্রেপ্তারি অভিযানে যেসব কথিত ব্লক রেইড হচ্ছে, তাতে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আটক করা হচ্ছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এবং সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের।
অতিব্যবহারে অবশ্য এ কৌশল যে আর কাজ করছে না, তার আলামত বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও এ কথা লেখা হচ্ছে। ৩০ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস তার প্রথম পাতায় ’এ টেস্ট অফ হার সুইপিং পাওয়ার’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখেছে, ”মিস হাসিনার ১৫–বছরের শাসনের একটি প্রতিষ্ঠিত কৌশল হচ্ছে সুযোগ পেলেই গ্রেপ্তার এবং সমাবেশ ভেঙ্গে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনে তিনি তৎপর হন।”
দেশের ভেতরেও আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে কথা উঠেছে যে সরকার ছাত্রহত্যার দায় এড়ানো এবং জবাবদিহির দাবি থেকে মানুষের নজর সরানোর শেষ চেষ্টা হিসাবে এখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। একটি প্রতিবাদসভার ভিডিওতে একজন ছাত্রীর মুখে শুনলাম, তিনি বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছিল, এত দিন তা করা হয়নি, এখন এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই করা হচ্ছে।
সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে কারফিউ দেওয়ার সময় থেকে প্রথম কয়েক দিন মন্ত্রীরা আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে যাওয়ার কথা বলে আসছিলেন। এখন তাঁরা বলছেন, তাঁদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে, যাতে প্রমাণ মিলেছে, বিএনপি–জামায়াত সহিংসতার সঙ্গে জড়িত। অতীতের গ্রেপ্তারগুলোর সময়েও আমরা একই বয়ান শুনেছি। অথচ গত ১৫ বছরে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা যে তেমন একটা প্রমাণ হয়েছে, তা নয়।
গত সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে কিছু মামলায় তড়িঘড়ি করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে অযোগ্য প্রমাণের জন্য কিছু নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হলেও আইন বিশেষজ্ঞরা মামলা নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের দায়ের করা মামলায় শুধু তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই রায় দেওয়া হয়েছে, যা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে অনেকেই একে ফরমায়েশি রায় হিসাবে অভিহিত করেছেন।
আন্দোলন দমনে যেসব কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা নজিরবিহীন। প্রথমে পুলিশ–বিজিবি এবং পরে সেনাবাহিনী নামিয়েই যদি আন্দোলনকারীদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করা হলো, তখন শুরুতে কেন ছাত্রলীগ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামানো হলো? বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ার অতীত অভ্যাস বৃহত্তর ছাত্র–গণআন্দোলন নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগবে, এমন ভাবনা যে পরিস্থিতিকে আরও সংঘাতময় করে তুলেছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
কোনো প্রাণহানিই গ্রহণযোগ্য নয় এবং তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আমাদের সবার প্রত্যাশা। কিন্তু বিরোধীদের ওপর দায় চাপানোর যে রাজনীতি এখন দেখা যাচ্ছে, তার পটভূমিতে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলোর যৌক্তিক বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমকাল পত্রিকায় ঢাকার চারটি সবচেয়ে সহিংসতাপীড়িত ঘটনাস্থলের ঘটনাক্রমের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পুলিশের সামনেই আগ বাড়িয়ে বিক্ষোভ ভেঙ্গে দিতে যেসব হামলা চালিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধই আসলে ব্যপকতা লাভ করে (এত প্রাণক্ষয় এত ধ্বংসযজ্ঞ, ২৫ জুলাই)। যাত্রাবাড়িতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে বিক্ষোভ ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদ এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে তাদের আক্রোশ পুলিশের ওপর গিয়ে পড়ে। সেখানেই একজন পুলিশকে মেরে পদচারী সেতুতে ঝুলিয়ে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে।
একই শিরোনামের নীচে উত্তরার যে ঘটনাক্রম তুলে ধরা হয়েছে, তাতেও সেখানে বিক্ষোভ দমনে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও দুজন কাউন্সিলরের কথা লেখা হয়েছে যে তাঁরা আক্রান্ত হওয়ার আগে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করেছেন। ১৮ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে বিক্ষোভকারীদের উপর চড়াও হওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিতে যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যের উপস্থিতির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তাড়িয়ে দেওয়ার পেছনেও শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ দেখা গেছে।
আন্দোলন কাছে থেকে দেখেছেন এবং ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবারের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়ায় সহিংসতার বিষয়টি সম্পর্কে কী বলেছেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা যায়। তাঁর কথায়, ”তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়ার অভিযোগ হাস্যকর। যেকোনো গণআন্দোলনে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নেমে পড়ে (রাষ্ট্র সব দিক থেকে অকার্যকর অবস্থায়, সমকাল, ২৮ জুলাই)।”
রাজনীতির বাইরের দলনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিদের পর্যবেক্ষণেও একই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল হাসিব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, ”আন্দোলনকারীদের সহিংস মনোভাব ছিল না। যখন তাদের ওপর বাধা ও আঘাত এল, তখন তারা প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়েছে (এটি আর শুধু ছাত্রদের আন্দোলন থাকল না, ১৮ জুলাই, প্রথম আলো)।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো আন্দোলন হয়নি, তা সে ছাত্রদের হোক অথবা সমাজের বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা পেশার, যার প্রতি আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয়নি, তাতে সক্রিয় সহায়তা করে নি। সেসব আন্দোলনও যে সহিংসতামুক্ত থেকেছে তা নয়; এবং তখনও যারা সরকারে ছিল, তারা আন্দোলনকারীদের ষড়যন্ত্রকারী অভিহিত করে নাশকতার অভিযোগ করেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা অতীতে বহুবার ঘটেছে, কিন্তু কখনোই তা এতটা দমনমূলক হয়নি।
এবারে প্রাণঘাতী অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার ও বেপরোয়া গুলিবর্ষণের যে অবিশ্বাস্য রেকর্ড তৈরি হয়েছে, তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যে, যাতে তিনি বলেছেন, ”গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কা স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি দখল করার টার্গেটও ওই রাতে ছিল। যদি কারফিউ জারি না হতো।” তাঁর কথায় গণ–অভ্যূত্থানের সম্ভাবনার স্বীকারোক্তি আছে। কিন্তু এই বক্তব্যে কি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এতগুলো প্রাণহানির দায় গ্রহণের স্বীকারোক্তিও নেই?
ছাত্র–গণআন্দোলনের মূল কারণ যে রাজনৈতিক সংকট তা এখন সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। এমনকি ১৪ দলের শরিক রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু এবং ১৪ দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার সহযোগী জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে হবে এবং তার জন্য আলোচনা প্রয়োজন (সব দল নিয়ে বসার পরামর্শ, যুগান্তর, ৩০ জুলাই)।
রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে আছে সরকারের নির্বাচনী বৈধতার প্রশ্ন, যার সমাধান শুধু একটি জোট বা কিছু দলের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার বিষয় নয়। অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ ধরণের সংকটে ক্ষমতার প্রশ্নে ছাড় দিয়ে একাধিকবার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। এবারও তো তেমন সমাধান পেতে হবে।
(১ আগস্ট, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন