সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সি’র আজীবনের ক্ষমতায়ন কতটা বিপজ্জনক ?


চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে যখন সি চিন পিংয়ের রাজনৈতিক ভাবনাকে সি- চিন্তাধারা হিসাবে স্বীকৃত দেওয়া হয়, তখনই ধারণা করা হয়েছিল রকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে চীনা বিপ্লবের নেতা পার্টির চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের রাজনৈতিক ভাবনা যেভাবে মাওয়ের চিন্তাধারা হিসেবে দলে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং অনুসৃত হয়েছিল, দলের সেক্রেটারি জেনারেল সি- রাজনৈতিক দিশার অনুরূপ স্বীকৃতিলাভ ইঙ্গিতবহ ছিল বৈকি
মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ১৫ বছরের কিশোর সি দলের নির্দেশে লাখো তরুণের মতোই দেশকে জানতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ফিরে গিয়েছিলেন বলা হয়, তিনি গুহায় জীবন যাপন করেছেন শাংসি প্রদেশের লিয়াংজিয়াহে সাত বছর কাটানোর পর তিনি বলেছিলেন, তিনি আত্মবিশ্বাসে পরির্পূণ এবং তাঁর জীবনের লক্ষ্য তিনি ঠিক করে ফেলেছেন তাঁর জীবনের সেই লক্ষ্য কী ছিল, তা আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না কিন্তু ধারণা করি, ১১ মার্চ রোববার চীনের পার্লামেন্ট বা পিপলস কংগ্রেস তাঁর সেই লক্ষ্য পূরণ করেছে দেড় কোটি মানুষের দেশে তিনি এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী
উনবিংশ কংগ্রেসেই তাঁর ভাবধারার যে মূল কথাটি আমরা জেনেছিলাম তা হলো, তিনি বলেছিলেন চীনকে মহান জাতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন প্রেসিডেন্ট পদে পাঁচ বছরের দুটি মেয়াদের অবসান ঘটানোর সংশোধনী অনুমোদনের পর পিপলস কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ঝ্যাং দেজিয়াং দলের সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, চীনকে আবার মহান জাতিতে রূপান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট সি- পেছনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে চীনকে আবার মহান বানানোর বিষয়টি অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরমেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’-এর মতো চীনকে আবারও মহান জাতিতে রূপান্তরে প্রেসিডেন্ট সি- ভাবধারাকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি উগ্র সংস্করণ থেকে খুব একটা আলাদা করা যাবে কি না, তা আগামী দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আরও স্পষ্ট হবে
মাওয়ের জীবদ্দশায় চীন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে তাদের লড়তে হয়েছে কিন্তু, একুশ শতকে চীনে শিল্প ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেছে দেশটি গত কয়েক দশকেবিশ্বের কারখানা খ্যাতি অর্জনের পর এখন নজর দিয়েছে সৃজনশীল অর্থনীতির দিকে বিশ্বে এখন তারা দ্বিতীয় প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি স্বভাবতই, প্রেসিডেন্ট সি- ভাবধারার প্রচারে এখন আলো-ঝলমলে শহরগুলো রঙিন বিলবোর্ডে ভরা
রাজনীতির পণ্ডিতেরা বলে থাকেন যে চীনের অভাবিত অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ তরুণ নেতৃত্ব দলের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে কেউ দুই মেয়াদের বেশি থাকতে না পারায় নতুন নেতারা নতুন উদ্দীপনা উদ্যোগ নিয়ে দলে নতুন জীবনীশক্তি যোগ করেছিলেন স্পষ্টতই এখন সেই ধারার অবসান ঘটছে তবে, গত কংগ্রেসে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি পলিট ব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে যাঁদের ওই বিধির কারণে সরে যেতে হয়েছিল, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, এখন সেটাও অবশ্য দেখার বিষয়
সি- এই আজীবন ক্ষমতায় থাকার বিরোধিতা দেশটির ভেতরের কেউ খুব একটা করার সাহস পাবেন বলে মনে হয় না তবে, অবসরে থাকা সংবাদপত্রের একজন সাবেক সম্পাদক লি দাতং, যিনি এর আগে উদারপন্থী সমালোচক হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন, তিনি একটি খোলা চিঠিতে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন গার্ডিয়ান তাঁর চিঠি উদ্ধৃত করেছে লি দাতং বলেছেন, ‘এই পদক্ষেপ চীন চীনা জনগণকে ধ্বংস করে দেবে সুতরাং, আমি চুপ থাকতে পারি না আমি তাঁদেরকে (পার্টি) জানাতে চাই যে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করার মতো লোক আছে
হংকং থেতে প্রকাশিত সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট- রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্যারি হুয়াং লিখেছেন, ‘ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে যে আজীবন দায়িত্বে থাকার চেষ্টা করেও অনেক নেতাই সফল হননি অনেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, অন্যরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছেন
প্রেসিডেন্ট সি- জীবনীকার এলিজাবেথ ইকোনমির ভাষায় বৈশ্বিক বিষয়গেুলোর কেন্দ্রে চীনকে প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি যে বিশ্বাস করেন, ক্ষমতার সব চাবি নিজের দখলে নেওয়ার মধ্যে তাঁর সেই প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটেছে
দল এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্ব একক কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকার আরেকটি বিপদের কথাও এলিজাবেথ মনে করিয়ে দিয়েছেন, যেটি আরও বেশি গুরুত্বর্পূণ তিনি বলছেন, চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যদি কমতে থাকে কিংবা কোনো একটি বড় দুর্যোগ দেখা দেয়, তাহলে সম্ভাব্য ব্যর্থতার দায়ও এককভাবে তাঁর কাঁধেই বর্তাবে
সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রাশিয়ার লৌহমানব পুতিন গত কুড়ি বছর একটানা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে সামান্য কৌশলী হয়ে কিছুকাল প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন হয়েছিলেন কিন্তু, চীনে প্রেসিডেন্ট সি সে রকম কোনো রাখঢাকের ধার ধারেননি চীনের এই পরিবর্তনের প্রভাব শুধু যে চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অর্থনীতির পরিধিতে আবদ্ধ থাকবে, তা নয় পুরো এশিয়া এবং বাকি বিশ্বকেও এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে



( ১২ মার্চ, ২০১৮ প্রথম আলোর মুদ্রিত সংস্করণে ‘আজীবন একনায়কত্ব‘ শিরোনামে প্রকাশিত লেখকের বিশ্লেষণ। )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...