বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বিধানের বৈধতার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোন
সিদ্ধান্ত দিতে পারে না বলে হাইকোর্ট বিভাগের নতুন রায় যে বেশ তাৎপর্য্যপূর্ণ সন্দেহ
নেই। আপিল বিভাগ এর আগে একাধিক মামলায় বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক পরিবর্তন সম্পর্কে
রায় দিলেও হাইকোর্ট বিভাগের এই নতুন সিদ্ধান্ত বিচারবিভাগের ভবিষ্যতের জন্যও বিশেষভাবে
গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে সংসদীয়
আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে আনীত রিট হাইকোর্ট
বিভাগের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের একক বেঞ্চ রোববার, ১৮ মার্চ খারিজ
করে দিয়েছেন। পুর্ণাঙ্গ রায়ের কপি এখনও প্রকাশিত হয় নি। তবে, আইনজীবিরা জানিয়েছেন,
রিট খারিজ করার আদেশে বলা হয়েছে, যেহেতু বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ ছিল,
সেহেতু এই অনুচ্ছেদটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কোনো আদেশ দিতে
পারে না।
আমরা জানি ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় প্রধান
বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের দলত্যাগ-নিরোধ
সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদকে সংসদ সদস্যদের ‘নিরপেক্ষ ও
পক্ষপাতহীন’ ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দলীয় নেতৃত্ব
যখন সাংসদদের আনুগত্যে আস্থাশীল হতে না পারায় সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ সংযোজিত
হয়েছে, তখন সেই সাংসদদের ওপর বিচারকদের বিচারের ভার দিতে বিচারকেরা কীভাবে আস্থা
রাখবেন আপিল বিভাগের রায়ে সেই প্রশ্নই তোলা হয়েছে। তবে, ৭০ ধারার প্রশ্নটি যেহেতু
মামলার বিচার্য্য বিষয় ছিল না সেহেতু রায়ে বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণের বাইরে তার
বৈধতার বিষয়ে কোনো আদেশ দেন নি। আপিল বিভাগ আদেশ না দিলেও তার পর্যব্ক্ষেণের আইনী
গুরুত্ব অনেক। কিন্তু, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে সেই পর্যবেক্ষণ কার্য্যত নাকচ করে
দেওয়া হলো।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সাত বিচারকই অভিন্ন মত দেন যে
‘সংসদের যে দলটি আইন তৈরি করে, ঠিক তারাই কেবিনেট বা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে।
তাই দুই স্তম্ভের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না। আর সেই একই গ্রুপ যদি বিচারকদের
অপসারণ করতে বসে, তাহলে তারা একইভাবে অভিন্ন দলীয় সিদ্ধান্তে চালিত হবে। সরকারের
চাপ এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরির কারণে বিদায় নিতে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধান
বিচারপতি এস এক সিনহা এবং আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার পর্যবেক্ষণে বিষয়টি স্পষ্টভাবেই
বলা আছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও ৭০
অনুচ্ছেদকে একটি ‘কঠোর বিধান’ হিসেবে চিহ্নিত করে লিখেছিলেন, সংসদ সদস্যরা তাঁদের অভিসংশনের ক্ষমতা
প্রয়োগ করার সময় কতটা পক্ষপাতহীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ
থেকেই যায়। বিচারপতি
মির্জা হুসেইন হায়দার লিখেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ টিকে থাকবে,
ততক্ষণ কোনো সংসদ সদস্যের অবাধে ভোটদানের স্বাধীন অভিপ্রায় থাকবে না।
ষোড়শ
সংশোধনীর রায় পর্যালোচনার জন্য সরকার যে রিভিউয়ের আবেদন করেছেন তার শুনানি এখনও
অনুষ্ঠিত হয়নি। রিভিউয়ে আপিল বিভাগ সাধারণত তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন না। আর, যদি করেনও তাহলেও সেই পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণ
নির্দেশনা (গাইডলাইন) হিসাবে অনুসৃত হওয়ার
কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের বিষয়ে আদালতের কোনো আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা নেই এমন
সিদ্ধান্তে স্পষ্টতই: ঐ নির্দেশনা অনুসৃত হয় নি।
উচ্চ
আদালতের আচরণে যে একটি গুরুত্বর্পূণ পরিবর্তন ঘটেছে ৭০ অনুচ্ছেদের মামলার আদেশে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। এর
আগে আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধির প্রশ্নে নিজেদের সিদ্ধান্ত এতোটাই
বদলেছেন যে এক নতুন নজির স্থাপন করেছে। এই পটভূমিতে বিচারবিভাগের স্বাধীনতার
প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট এখন কতটা ছাড় দেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। রাজনৈতিক মামলা
অথবা মামলার রায়কে রাজনৈতিক অভিহিত করে যাঁরা ক্ষুব্ধ তাঁদের জন্যও এই রায় কিন্তু কম
উদ্বেগজনক নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন