সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জুলুম এখন নতুন রেওয়াজ

জুলুম বা নির্যাতন এখন নতুন রেওয়াজ বা ফ্যাশন। এগুলো আমার কথা নয় এবং কোনো দেশকে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করেও এই বক্তব্য দেওয়া হয়নি, যদিও অনেকেই অনেক দেশের সঙ্গে এর আংশিক বা পুরোপুরি মিল খুঁজে পেতে পারেন। চার বছর ধরে মানবাধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে অনেকটা হতাশার সঙ্গে বিদায় নেওয়ার সময়ে এসব কথা বলেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যেইদ রাদ আল হুসেইন। তিনি বলছেন, বিশ্বে নির্যাতন বা জুলুম আবার ফিরে আসছে। মানুষের অধিকার রক্ষাই হচ্ছে এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ (সূত্র ইউএননিউজ, ১৫ আগস্ট, ২০১৮)। 
জর্ডানের রাজবংশের সন্তান এই কূটনীতিক জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের প্রধান পদে আরও এক মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকলেও তিনি সেই সুযোগ নিতে আগ্রহী হননি। গত ডিসেম্বরে তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে পাঠানো এক ই-মেইলে ওই সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। ই-মেইলে তিনি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধির যেসব কথা জানিয়েছিলেন, ফরেন পলিসি সাময়িকী সেটির বক্তব্য প্রকাশ করে দেয় (ফরেন পলিসি, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭)। তখনই তিনি বলেছিলেন, মানবাধিকারের সুরক্ষা বা তার পক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এখনকার পরিবেশটা আতঙ্কজনক। ওই পরিবেশকে তিনি দায়িত্ব নবায়নের চেষ্টা না করার কারণ হিসেবে তুলে ধরে লিখেছিলেন যে এ জন্য হয়তো তাঁকে অনেকের কাছে হাঁটু গেড়ে নত হতে হবে। সাময়িকীটি জানিয়েছিল, এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনার ভাষা নরম করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
যেইদের এই বক্তব্যে বিশ্বজুড়েই মানবাধিকারকর্মীদের কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হয়েছে। একজন মুসলমান, আরব এবং এশীয় হিসেবে তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি এবং কঠিন হলেও জাতিসংঘ সংস্থার মানবাধিকার কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে তাঁর এই বক্তব্য সবার জন্যই অশনিসংকেত। ২০১৪ সালে তিনি যখন এই পদে আসীন হন, তখন বিশ্বজুড়ে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থান মোকাবিলায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ তুঙ্গে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিগুলো মেনে চলার জন্য সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কাজটির বিপরীতে এখনকার বিভাজন ও বিদ্বেষের রাজনীতিতে নির্বাচিত রাজনীতিকদের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার বিপদ যে কতটা গুরুতর হয়ে উঠছে, সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যেইদ। এসব নির্বাচিত জননেতাদের অনেকেই ভর করেছেন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদী নীতি ও আদর্শের ওপর। অনেকেই অর্ধসত্য ও অসত্যকে ভর করে ‘বিকল্প সত্যে’র এক কাল্পনিক জগৎ গড়ে তুলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী অভিবাসন নীতি, অভিবাসীদের আটক করা ও বিতাড়ন এবং পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের বিচ্ছিন্ন করার বহুল নিন্দিত নির্দেশনা কিংবা গণমাধ্যমকে জনগণের শত্রু অভিহিত করার ঘটনা; ফিলিপাইনে দুতার্তের মাদকবিরোধী অভিযানে সন্দেহভাজনদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যার নির্দেশ; ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বিচার বোমা হামলা এবং অবরোধ আরোপ; ফিলিস্তিনি অধিকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলি সেনাদের নিষ্ঠুরতা ও গাজার অবরোধ; নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলায় সরকারবিরোধীদের দমন; কম্বোডিয়ায় বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠান; ভারতে হিন্দুত্ববাদী উগ্র গোষ্ঠীগুলোর গোরক্ষা আন্দোলনের নামে সংখ্যালঘু মুসলমান হত্যা; তুরস্কে ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ কিংবা চীন ও উত্তর কোরিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা—এসব কিছুর বিরুদ্ধেই যেইদ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানটি সোচ্চার ছিল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সামরিক অভিযানকে তিনিই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সমতুল্য বলে অভিহিত করেছিলেন। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী অভিযানে বিনা বিচারে হত্যা এবং গুম এর প্রসঙ্গও একাধিকবার তাঁর কথায় উঠে এসেছে।
মানবাধিকারের সুরক্ষার ক্ষেত্রে যেসব বিপদ এখন প্রকট হয়ে উঠছে, বিদায়কালে তিনি সেগুলোর কথাই আরও জোরালো এবং স্পষ্ট করে বলেছেন। ২০ আগস্ট জেনেভায় সাংবাদিকদের যেইদ বলেছেন, বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষা ভুলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানে তিনি এই বিপদ দেখছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং সিরিয়া প্রশ্নে সমঝোতা না হওয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার কথা বলেছেন। ক্ষমতার এই ভারসাম্যহীনতার অবসান না হলে বিশ্বব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
যেইদ আরও একটি মোক্ষম যুক্তির কথা বলেছেন ইউএননিউজকে। তাঁর কথায়, সরকারগুলো নিজেদের রক্ষার জন্য যথেষ্টভাবে সক্ষম, তাদের সুরক্ষা দেওয়া জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কাজ নয়। তাঁদের দায়িত্ব নাগরিক সমাজ, ঝুঁকিতে থাকা বা বিপন্ন জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক এবং নিপীড়িত মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। বিশ্বজুড়েই মাঠপর্যায়ের মানবাধিকারকর্মীরা নিশ্চিতভাবেই তাঁর এই উপলব্ধির সঙ্গে একমত হবেন যে মানবাধিকার রক্ষার কাজে আসল চাপটা অনুভূত হয় নিপীড়নের শিকার মানুষগুলোর তরফে এবং সেটা এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে; কেননা বিশ্বে নির্যাতন বা জুলুম আবার ফিরে আসছে।
(২৩ অগাস্ট, ২০১৮ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...