অনেক মা-বাবার কান্না, সহপাঠীদের চাপা ক্ষোভ এবং নাগরিকসমাজের প্রতিবাদের মুখে
প্রথমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থক ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে এবং পরে কোটাসংস্কার আন্দোলনের
কয়েকজন নেতা বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ঈদের আগে তাঁদের মুক্তিলাভ পরিবারগুলোতে
স্বস্তি এবং আনন্দ এনে দিয়েছে সন্দেহ নেই। এসব ছাত্র-ছাত্রী এবং একজন নারী শিক্ষক কয়েকদিন
থেকে কয়েকসপ্তাহ দু:সহ কারাজীবন কাটানোর পর জামিন পেয়েছেন। আদালত তাঁদেরকে জামিন দেওয়ার
পর আইনমন্ত্রী বলেছেন সরকার মানবিক কারণে মহানুভবতা দেখিয়ে তাঁদের মুক্তি দিয়েছে। আইনমন্ত্রী
আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমরা মহানুভবতা দেখিয়েছি। এখন আমরা আশা করছি,
ওরা আর কোনও গুজবে কান দেবে না, গুজব ছড়াবে না, কোনও গুজবে বিভ্রান্ত হবে না। একইসঙ্গে
একজন নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি দরদ, ভালোবাসা, মমতা ও দেশাত্মবোধ দেখাবে‘ (বাংলা ট্রিবিউন, ২০ আগস্ট, ২০১৮)।
ব্যাক্তিজীবনে ত্যাগের শিক্ষা দেয় যে ঈদ, সেই উৎসবের আগে সরকারের
এই কথিত ‘মহানুভবতা‘য় মুগ্ধ হয়ে অনেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আবার, অনেকে
এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজেছেন। যাঁরা এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন
তাঁদের বক্তব্য নিরাপদ সড়কের দাবি মানার পাশাপাশি এসব আটক কিশোর-তরুণদের প্রতি উদারতা
দেখানোর মধ্য দিয়ে সরকার আন্দোলনকারীদের আস্থায় নিতে চাইছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির
আন্দোলনের মত একই কৌশল অনুসরণের পথে হাঁটছেন তাঁরা।
সরকার যে কত মহানুভব তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে আনিসুল
হক বলেছেন, ‘ওদের প্রতি সহানুভূতিশীল
বলেই আমরা এ ক্ষেত্রে মহানুভবতা দেখিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম,
যে আদালত যদি ওদের জামিন দেন, তাহলে প্রসিকিউশন থেকে আমরা এ বিষয়ে আপত্তি করবো না।
শুধু তা-ই নয়, জামিন পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ জন শিক্ষার্থীর পক্ষে কোনও আইনজীবী
ছিলেন না। সরকারের পক্ষ থেকে ওদের পক্ষে প্রসিকিউশন নিয়োগ করে ওদের জামিনের কাগজপত্র
জমা দিয়েছি।’
যাঁদের কারণে এসব কিশোর-তরুণ মুক্তি পেলেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানানোয় কার্পণ্য
করা কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু, সরকারের মানবিকতা জাগ্রত হওয়া এবং মহানুভবতা দেখানোর
দাবির কারণে এই প্রশ্নটি না করলেই নয়। ধন্যবাদ আমরা কাকে দেবো? আদালত নাকি সরকারকে
? সরকার যদি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতেন তাহলে আর এই প্রশ্নটি উঠতো না। কিন্তু, অভিযোগ
বা মামলা প্রত্যাহারের মত কোনো পদক্ষেপের কথা তো আমরা শুনিনি।
আমরা জেনেছি যে আদালত তাঁদেরকে জামিন দিয়েছেন। এখন আদালতের সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব
যদি আইনমন্ত্রী দাবি করেন তাহলে তার মানে কি দাঁড়ায়? সরকারের এই দাবির পিছনে রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য থাকলে তা আদালতের স্বাধীনতা সম্পর্কে কি ধারণা দেয়? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিএনপি
এতোদিন ধরে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে যে আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে
না – সেই দাবি
বিশ্বাসযোগ্য করায় মন্ত্রীর এই বক্তব্যে দলটি খুশি হবে বৈকি। বিএনপি নেত্রীর জামিন
প্রশ্নে সরকারের কঠোর বিরোধীতা কিম্বা দূর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দুদকের আইনজীবি
থাকলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের চোখে পড়ার মত উদ্যোগী ভূমিকায়
ক্ষুব্ধ দলটি গত কয়েকমাস ধরে এই কথাটিই বলে আসছে। তাঁদের বক্তব্য সরকারের কারণেই বিএনপি
নেত্রী সুবিচার পাচ্ছেন না।
আদালতকে কোনো মামলার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে কিনা তা আমাদের জানা
নেই। কিন্তু, মন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে সরকার মহানুভবতা না দেখালে এসব ছাত্র-ছাত্রীর
জামিন হয়তো হোত না। অভিজ্ঞতা বলে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি না থাকলে আদালত সাধারণত জামিন
দিতে কসুর করেন না। জামিন এবং রিমান্ড প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা নিম্ন আদালতে
অব্যাহতভাবে উপেক্ষিত হওয়ার পটভূমিতে সরকারের মহানুভবতার দাবি হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু,
প্রশ্ন হচ্ছে আইনমন্ত্রী এদের প্রতি মহানুভবতা দেখিয়ে থাকলে যাঁরা জামিন পেলেন না তাঁদের
প্রতি তিনি কি কঠোরতা দেখালেন? ধানমন্ডির কফি হাউজের মালিক গৃহিণী কিম্বা আলোকচিত্রী
শহীদুল আলম যে জামিন পেলেন না তা যদি তাঁর এই কঠোরতার কারণে হয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রী
হিসাবে তিনি যে শপথ নিয়েছেন তার বিচ্যূতির অভিযোগ কি নাকচ করা যায়? মন্ত্রী হিসাবে
তিনি তো কারো প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। কথিত মহানুভবতার
জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তাঁর যেমন প্রত্যাশা আছে, তেমনই কি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে শপথভঙ্গের
অভিযোগ উঠলে তাঁর পদত্যাগ আশা করা যাবে?
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য আটক ছাত্র-ছাত্রীদের আইনজীবিরা জামিন চাওয়ার সময়ে
আদালতে বলেছেন যে এজাহারে তাঁদের কারো নাম নেই এবং সেকারণে সন্দেহের বশে আটক কিশোর-তরুণদের
জামিন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই আন্দোলনের কারণে যে শতাধিক ব্যাক্তি আটক হয়েছেন
তাঁদের মধ্যে সহিংসতার সময়ে ঘটনাস্থল থেকে আটক হয়েছেন এমন কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। যদি
থেকেও থাকেন তা একেবারেই নগণ্য। অর্থাৎ আইনভঙ্গ বা শান্তিরক্ষার প্রয়োজনে এঁদেরকে গ্রেপ্তার
করতে হয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়। বিস্ময়করভাবে অনেককেই ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঞ্ছিত করা
পর পুলিশের কাছে দিয়েছে এবং থানা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বাধিত থেকেছে। যে ৫৭ ধারা
বাতিল হওয়ার কথা সেটিরই সর্ব্বোচ্চ অপপ্রয়োগ ঘটছে।
সবচেয়ে বড় কথা, আসল অশান্তিসৃষ্টিকারী হেলমেটবাহিনীর অনেকের পরিচয় প্রকাশের
পরও গত দুসপ্তাহে তাদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। পুলিশ হামলাকারীদের খোঁজে না, কিন্তু,
আন্দোলনকারীদের ধরপাকড়ের জন্য সবাই মাঠে নেমেছেন। থানা পুলিশের পাশাপাশি বিশেষ পরিস্থিতি
সামাল দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা চৌকষবাহিনী র্যাব, সন্ত্রাসবিরোধী কার্য্যক্রমের জন্য
গঠিত অ্যান্টি-টেরর ইউনিট এবং সাইবার অপরাধ দমনের সাইবার ক্রাইম ইউনিট সবাই নেমে পড়েছেন
আন্দোলনকারীদের ধরতে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন অথবা কোটসংস্কারের আন্দোলন মোকাবেলায় র্যাব
কিম্বা সন্ত্রাস দমন ইউনিট নিয়োগের কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে
রাতেরবেলায় তার দাদাবাড়ির দরোজা ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠিয়ে ধরে নিয়ে আসার মত ‘মহানুভবতা‘ এসব ছাত্র-তরুণদের
আজীবন মনে থাকবে, সন্দেহ নাই। সত্যতা যাচাই না করে ভিত্তিহীন কানকথা প্রচারের দোষ স্বীকার
করে নেওয়ার পরও একজন নারীকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন হয় কেন – এই প্রশ্ন
কোনোভাবেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়। জুলুম-নির্যাতন আবার ফিরে এসেছে এবং তা এখন
নতুন ফ্যাশন বলে জাতিসংঘের বিদায়ী মানবাধিকার প্রধান যেইদ রাদ আল হুসেইন সম্প্রতি যে
বৈশ্বিক প্রবণতার কথা বলেছেন মনে হয় বাংলাদেশ তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন মোকাবেলায় সরকারের
দমননীতি শুধু যে আন্দোলনকারীদের মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে তা নয়। প্রথমে তা বিস্তৃত
হয়েছে বিরোধীদল বিএনপির দিকে। একটি ন্যায্য দাবির আন্দোলন সমর্থনের ‘অপরাধে‘ তাদের বিরুদ্ধে সরকারপতনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
আনা হয়েছে। কথিত টেলিফোন সংলাপ ফাঁস এবং তাকে কেন্দ্র করে মামলাও হয়েছে।
সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বিস্তৃত হয়েছে নাগরিক সমাজের একটি অংশ এবং
যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আটক
করা হয়েছে নন্দিত আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে। তাঁর মুক্তির জন্য নোবেলবিজয়ী থেকে
শুরু করে তাবৎ বিশ্বের বৃদ্ধিজীবিরা বিবৃতি দিচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় নিবন্ধ লিখছেন।
মাত্র মাস চারেকের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয়
নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠূ করার জন্য একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতার
প্রসঙ্গ যখন জনআলোচনায় প্রাধান্য পাওয়ার কথা তখন সবার মনোযোগ ও দৃষ্টি হচ্ছে
শহীদুল আলমসহ গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির বিষয়টিতে। বলতেই হবে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী
লীগের জন্য এটি হচ্ছে মন্দের ভালো। কেননা, ২০১৪‘র বিনা
প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচন যে রাজনৈতিক সংকটের উৎস সেই সংকট নিরসনের রাজনৈতিক
সমাধান আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। সেক্ষেত্রে, নানাধরণের
অস্থিরতার কারণে কোনোধরণের রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই
দিয়ে আরো একটি নির্বাচন নিজেদের মনমতো করিয়ে নেওয়া অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন