সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ব্রিটিশ রাজনীতিতে তৃতীয় ধারার সূচনা ?


প্রথমে লেবার পার্টিতে রক্তক্ষরণ। তারপর টোরি পার্টিতে। ব্রিটিশ রাজনীতির সংকটের এক নতুন রুপ। লেবার পার্টি থেকে ৮জন দলত্যাগ করে স্বত্ন্ত্র হিসাবে নিজেদেরকে ঘোষণা দেওয়ার পর এবং তাঁদের সঙ্গে এখন যুক্ত হলেন টোরি পার্টির ৩জন। বুধবার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের দিন থাকায় ধারণা করা হচ্ছিলো বিরোধীনেতা জেরেমি করবিন আজ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। কিন্তু, সকালেই টোরি পার্টির ৩ সদেস্যের দলত্যাগ প্রধানমন্ত্রীর জন্যও বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, বাস্তবতাকে অস্বীকারে প্রধানমন্ত্রী মে এবং বিরোধীনেতা জেরেমি করবিন অভিন্ন ভূমিকা নিয়ে নিজ নিজ দলের সংকট এবং দলত্যাগীদের বিষয়ে নীরব রইলেন।

ইউরোপ থেকে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত যে প্রতিষ্ঠিত বড় দুই দলের জন্য কতটা গভীর চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে উভয় দলের নেতারাই সম্ভবত তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার পরিণতিতে বিচ্ছেদের গভীরতা কতটা ব্যাপক এবং তার প্রভাব কতটা সহনীয় করে তোলা সম্ভব সে বিষয়ে সরকার এবং বিরোধীদল উভয়েরই নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়ায় এই ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হয়েছে।

নতুন এই ১১ জনই বলেছেন ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারার দলগুলো বিদ্যমান সংকটের সমাধানে অক্ষম। তাঁরা সবাই দ্বিতীয় আরেকটি গণভোটের মাধ্যমে ব্রেক্সিট প্রশ্নের সমাধান চান। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির সমালোচনা করলেও আপাতত কোনো বিকল্প হাজির করেন নি।

সমস্যার উৎস হচ্ছে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্নে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত গণভোট। ওই গণভোটে প্রধান দুই দলই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ছিল। তবে, প্রধানত: টোরি পার্টির একটি বড় অংশ ছিলো বিচ্ছেদের পক্ষে। ব্রেক্সিটের মূল প্রবক্তা ছিল ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি (ইউকিপ)। গণভোটের রায় মাত্র চার শতাংশ ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিটের পক্ষে যাওয়ায় মূল ধারার অনিচ্ছুক রাজনীতিকদের ঘাড়েই দায়িত্ব পড়ে তা বাস্তবায়নের। গণভোটের উদ্যোক্তা ডেভিড ক্যামেরন রাজনীতির মঞ্চ থেকে বিদায় নিলে প্রধানমন্ত্রী হয়েই মে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে সাধারণ নির্বাচনের পথে হাঁটেন। উভয় দলই তখন গণভোটের রায় বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে বাধ্য হয়। ২০১৭য় নির্বাচন না হলে ব্রেক্সিট প্রশ্নে দ্বিতীয় আরেকটি গণভোট আয়োজন যতটা সহজ হতো এখন তা ততোটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

ব্রেক্সিট কেমন হলে সহনীয় এবং গ্রহণীয় হবে সে প্রশ্নে পার্লামেন্টে অচলাবস্থা কেবলই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আর, তাই এসব দলত্যাগী এমপিরা আরেকটি গণভোটেই বিষয়টির নিষ্পত্তি চান। আগামী কয়েকদিনে এই দলত্যাগের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে রাজনীতির অন্দরমহলের খবর। তবে, এসব দলছুটরা অচিরেই নতুন দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এমন কোনো তাড়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে এঁরা সবাই মধ্যপন্থী হিসাবে পরিচিত। থেরেসা মের নেতৃত্বাধীন টোরি পার্টির অতি-ডানপন্থায় ঝুঁকে পড়া এবং বিপরীতে জেরেমি করবিনের অতি-বাম পরিচিতির কারণে মধ্যপন্থী উদারনৈতিক রাজনীতির প্রশ্নে একটি শুণ্যতা অনেকেই উপলব্ধি করে আসছেন। এই গোষ্ঠীর প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের একধরণের আদর্শিক নৈকট্য থাকায় রাজনৈতিক দল হিসাবে তাঁরা আত্মপ্রকাশ করলে তা তৃতীয় ধারা হিসাবে জায়গা করে নিতে পারে। তবে, এসব এমপিরা দলের মূলধারা থেকে সরে যাওয়ায় ভবিষ্যতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বা নতুন দলের পরিচয়ে কতটা সফল হবেন তা নিশ্চিত নয়।

এসব এমপির দলত্যাগের তাৎক্ষণিক প্রভাব সরকার এবং বিরোধীদল উভয়ের জন্যই বাড়তি অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। থেরেসা মে এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ডের দল ডিইউপির ওপর নির্ভরশীল। তাঁর দলের শক্তিক্ষয়ের মানে হচ্ছে ভবিষ্যতে যে কোনো আইনপাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে গণভোটের বদলে আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের অনিবার্য্য হয়ে পড়তে পারে। বিপরীতে, বিভিন্ন ইস্যূতে লেবার পার্টি ছেড়ে যাওয়া এমপিদের সমর্থন আদায়ের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে, যা স্পষ্টতই বিরোধীদলকে দূর্বল করবে।

লেবার পার্টি এবং তার নেতা জেরেমি করবিন বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রেক্সিট প্রশ্নে অচলাবস্থা নিরসনের জন্য আরেকটি সাধারণ নির্বাচন দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু, তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দলটির একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই ইহুদিবিদ্বেষীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে আসছেন। দলত্যাগকারী এমপিদের মধ্যে লেবার ফ্রেন্ডস অব ইজরায়েল নামের গোষ্ঠীর সভাপতি এবং কয়েকজন সদস্যও আছেন। এই প্রচারণায় তাঁদের সঙ্গে আছে টোরি পার্টি এবং গণমাধ্যমের একটি প্রভাবশালী অংশ। ফলে, আরেকটি নির্বাচনে তাঁর সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এসব এমপিদের দলত্যাগের পর পরিচালিত প্রথম জনমত জরিপের ফলেও সেরকমই ইঙ্গিত মেলে।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...