চির
প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারির অঘোষিত
আকাশযুদ্ধের ঘটনায় বিশ্ব জুড়েই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে, যার প্রধান কারণ হচ্ছে ঊভয় দেশের
পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার এবং বৈরিতার দীর্ঘ ইতিহাস। যুক্তরাষ্ট্র যখন এশিয়ারই আরেকটি
প্রান্ত – কোরীয় উপদ্বীপের বিপারমাণবিকীকরণে
মনোনিবেশ করেছে, ঠিক তখনই দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ এমন এক লড়াই প্রত্যক্ষ
করছে যার পারমাণবিক যুদ্ধে রুপান্তরিত হওয়ার আশংকা একেবারে অমূলক নয়।
২৭
ফেব্রূয়ারি পাকিস্তান ও ভারতের পাল্টাপাল্টি আকাশসীমা লংঘন এবং ভারতীয় একজন বৈমানিক আটক হওয়ার পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীনসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই অত্যন্ত
দ্রুততার সঙ্গে উভয়পক্ষের প্রতি সংযত হওয়ার আহ্বান জানায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে এমনকি শ্রীলংকা এবং নেপালও সংযম এবং আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। সার্কের বর্তমান চেয়ারম্যান
হিসাবে নেপাল তার বিবৃতিতে উত্তেজনা প্রশমন ও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। তবে,এক্ষেত্রে
বাংলাদেশের নীরবতা লক্ষ্যণীয়।
দক্ষিণ
এশিয়ায় সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রলয় ঘটলে বাংলাদেশে যে তার আঁচড় লাগবে না, বিষয়টা এমন
নয়। তাহলে, আমাদের নীরবতার মানে কি আমরা বিপদটি উপলব্ধি করতে অক্ষম ? নাকি, আমরা ‘কারো প্রতি বৈরিতা নয়, সবার প্রতি বন্ধুত্বের‘ নীতি অনুসরণের নামে নিজেদের সম্ভাব্য বিপদেও বিপদ সৃষ্টিকারীদের
কিছু না বলাকেই শ্রেয় বিবেচনা করছি? আমরা জানি, ২০১৬‘র সেপ্টেম্বরে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায়
১৭ জন সৈন্য নিহত হওেয়ার ঘটনার পর বাংলাদেশ ভারতের ‘সন্ত্রাসবিরোধী
পদক্ষেপের‘ প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলো।
এখনকার নীরবতার অর্থ কি এই যে বর্তমান সংঘাত পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধের রুপ নিলে বাংলাদেশ
একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে? নাকি, আমরা শান্তির্পূণ উপায়ে সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে
পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে বিপারমাণবিকীকরণের পথে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করব ?
স্মরণ
করা যেতে পারে যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার তিক্ততা ও উত্তেজনা প্রশমনে ১৯৯৮ সালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যস্থতার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, তখন ভারত আগ্রহী হয়
নি। তার পরের বছরই কারগিলে উভয় দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মাত্র বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে এক
নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন বিজেপির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী
এল কে আদভানি শেখ হাসিনাকে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধের
বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছে তাতে অবশ্য
সেরকম উদ্যোগ গ্রহণের বাস্তবতা ছিল না। উভয় দেশের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক যে অচিরেই পুনরুজ্জীবিত
হবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপারমাণবিকীকরণের চাপ তৈরির একটি সম্ভাব্য
ফোরাম হতে পারতো দক্ষিণ এশীয় জোট সার্ক, যা এখন কার্য্যত মৃত বা জীবন্মৃত।
বিশ্বনেতারা
এটা ভালোই জানেন, যুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার গতিপথ নির্ধারিত হয় যুদ্ধক্ষেত্রেই।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তব্যে এর একটা স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। তিনি
বলেছেন ‘আমাদের উভয় দেশের যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে তাতে আমাদের পক্ষে কী কোনো ভুলের মাশুল
বহন করা সম্ভব‘? তিনি আরও বলেছেন যে যুদ্ধ শুরু হলে তা যেমন তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, তেমনই তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। পাকিস্তানের রাজনীতিতে
সামরিকবাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি সবারই জানা এবং ইমরান খান তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এধরণের পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকাই মূখ্য হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে, ভারতে
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিকবাহিনীর ওপর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব অক্ষূণ্ন
থাকলেও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পরিস্থিতিকে গুরুতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আশংকাও
প্রবল। স্মরণ করা যেতে পারে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত পাকিস্তানের মূল ভুখন্ডের বালাকোটে
বিমান হামলা চালানোর পর বলেছিলো যে এটি স্ন্ত্রাসীদের আখড়া গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত
একটি অসামরিক অভিযান। কোনো সামরিক ও সরকারী স্থাপনা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলা না বলে
ভারত যে বক্তব্য দিয়েছিলো তার উদ্দেশ্য ছিল পাল্টা সামরিক ব্যবস্থাগ্রহণ থেকে পাকিস্তানকে
নিরুৎসাহিত করা। পাকিস্তানও একইভাবে ২৭ ফেব্রুয়ারির বিমানহামলার পর বলেছে যে তারা তাদের
সামরিক সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ার লক্ষ্যে কোনোধরণের প্রাণহানি এড়াতে সামরিক-বেসামরিক
স্থাপনায় হামলা না করে ফাঁকা মাঠে বোমাবর্ষণ করেছে । কিন্তু, উভয়পক্ষের কথিত অসামরিক
অভিযান শেষপর্যন্ত সামরিক রুপ নিয়েছে।
অতীতের
সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের এবারের সংঘাতের মিল-অমিল দুটোই রয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালেও ক্ষমতায়
ছিল বিজেপি। তখনও ভারতে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন বিজেপির অবস্থান র্দূবল হতে থাকার
মধ্যে ওই যুদ্ধের পরিণতিতে বিজেপি লাভবান হয়, নির্বাচনে বৃহত্তর ম্যান্ডেট লাভ করে।
এবারেও, বিজেপির জনসমর্থনে ভাটার টান শুরু হওয়ায় তিনটি গুরুত্বর্পূণ রাজ্য বিধানসভায়
দলটি পরাজিত হয়েছে। কৃষক অসন্তোষ, রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে দূর্নীতির অভিযোগসহ অনেকগুলো
বিষয়ে সরকার কোণঠাসা এবং বিরোধীদের জোট যখন বিকল্প হিসাবে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখন এই
সামরিক সংঘাত জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দিলে তাতে দলটি লাভবান হবে। ইতিমধ্যে, প্রধানমন্ত্রী
মোদি এবং বিজেপি প্রধান নিজেদের ভারতের অখন্ডতার রক্ষক হিসাবে তুলে ধরার
কৌশল নিয়েছেন। তাঁর দলের নেতারা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এই যুদ্ধের কারণে তাঁরা
নির্বাচনে সাফল্য লাভ করবেন। অন্যদিকে, বিরোধী ২১ দলের জোট সামরিক অভিযানকে সমর্থন
করলেও বিষয়টি নিয়ে বিজেপির রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন।
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির চাপ এই সংঘাতকে কোনদিকে নিয়ে যাবে, তা স্পষ্টতই ভাবনার বিষয়।
হ্যানয়ে
কোরীয় বিপারমাণবিকীকরণ আলোচনা ব্যর্থ হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন ভারত-পাকিস্তান
সংকটে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শান্তির লক্ষ্যে তাদের হাতে বন্দী ভারতীয় বৈমানিক উইং কমান্ডার
অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভারত তার নি:শর্ত মুক্তি চেয়েছিল। ফলে, ধারণা
করা অমূলক হবে না যে নেপথ্যের কূটনীতি এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তবে, তা উত্তেজনা প্রশমন
করে যুদ্ধের আশংকা দূর করতে সক্ষম হবে কিনা তা স্পষ্ট হতে আমাদেরকে আরও অপেক্ষা করতে
হবে।
অতীতের
সঙ্গে এবারের সংঘাতের অমিলটা হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে তৈরি হওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
এই মাধ্যমে একধরণের হিস্টিরিয়া বা গণউন্মাদনা তৈরির চেষ্টা চলছে। হ্যাশট্যাগ ‘আইদার
নাও অর নেভার‘ টুইটের মত বেশ কিছু টুইটে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। প্রথমে ভারতে এবং তার
অনুসরণে পাকিস্তানেও টিভির পর্দায় উপস্থাপকরা হাজির হচ্ছেন সামরিক পোশাক পরে। উগ্রজাতীয়তাবাদী
বাকযোদ্ধারা সাংবাদিকতায় যে নতুন রং চাপাচ্ছেন তা অতীতে কখনোই দেখা যায় নি।
তবে,
আশার কথা হচ্ছে এতো সব উন্মাদনার মধ্যেও টু্ইটারে সবচেয়ে বেশি যেকথাটি প্রচারিত হয়েছে
তা হচ্ছে ‘সে নো টু ওয়ার‘ (যুদ্ধকে না বলুন)। যুদ্ধকে যাঁরা না বলছেন তাঁদের
অধিকাংশই তরুণ। টুইটার আরও জানিয়েছে যে যুদ্ধকে না বলার এই আহ্বান আসছে বিবদমান সীমান্তের
উভয়প্রান্ত থেকেই। আমাদেরও উচিত হবে সেই আওয়াজ তোলা। এবং তা শুধু নাগরিক সমাজ থেকে
নয়, সরকারের পক্ষ থেকেও।
( নিবন্ধটি কিছুটা সংক্ষেপিত রুপে ১ মার্চ, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন