নিম্নবিত্তরা স্বপ্ন দেখার ফুরসৎ পায় না। কেননা, দু:স্বপ্ন সারাক্ষণ তাদের তাড়িয়ে
নিয়ে বেড়ায়। কিন্তু, মধ্যবিত্ত স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নবিলাসেই তার ভরসা। স্বপ্ন তাকে এগিয়ে
চলার উৎসাহ দেয়, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগুতে সাহায্য করে। আগে আমরা স্বপ্ন দেখার
অবকাশ ছিল না, তাই আমরা ছিলাম নিম্ন-আয়ের দেশ। এখন আমরা স্বপ্নবাজ এবং আমাদের দেশটাও
তাই তরতরিয়ে মধ্যম আয়ের গোত্রভুক্ত দাবি করে উৎসবও করে ফেলেছি। আর, মধ্যম আয়ের দেশ
হলে পারমাণবিক বিদ্যূৎের স্বপ্ন দেখবো না, তা কি হয়?
রুপপুরের পরমাণু বিদ্যূৎ কেন্দ্রের স্বপ্ন রুপায়ণ তাই আমাদের উন্নয়নের অগ্রাধিকার
পাওয়া প্রকল্প। ইউরোপের দেশগুলো যখন ঝুঁকি বিবেচনায় পরামাণু বিদ্যূত থেকে সরে আসছে,
জার্মানির মত ধনী দেশ ২০২২ এর মধ্যে চালু পরমাণু বিদ্যূত কেন্দ্রগুলো বন্ধের ঘোষণা
দিয়েছে তখন আমরা পরমাণু বিদ্যূতকেই ভবিষ্যতের অংশ ভাবছি। এমনকি, এতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ
প্রয়োজন হওয়ার পরও আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিতেও পিছপা হইনি।
মর্যাদার কাছে টাকা যে কোনো বিষয় নয় সেটা আমাদের উন্নয়ন তত্ত্বের একটা বড় বৈশিষ্ট্য।
তাই, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্পণ্য করা মানায় না। রুপপুর প্রকল্পের সরকারী ওয়েবসাইটে
প্রকল্পের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অর্জিত অগ্রগতির পুরো ইতিহাস এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব
প্রযুক্তি ও কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তি হয়েছে সেগুলোর বিবরণ দেওয়া আছে। তবে, খরচের বিবরণ
নেই। তবে, দুবছর আগের হিসাবে এই প্রকল্পের খরচ তুলনীয় অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে অনেক
বেশি।
আমাদের রুপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বন্ধুপ্রতিম দেশ রাশিয়া। তারা ভারতেও
একইধরণের বিদ্যূৎ প্রকল্প বানিয়ে দিয়েছিল যার কাজ শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে। বাংলাদেশ
পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মতিনের দেওয়া হিসাবে ভারতের কুন্দকুলামের
ওই কেন্দ্রের দুটি ইউনিটে উৎপাদিত বিদ্যূতের দান পড়ছে প্রতি কিলোওয়াটে ১৩০০ ডলার। এখন
তারা সেখানে ৩ ও ৪ নম্বর ইউনিট তৈরি করছে যে দুটির বিদ্যূতের দাম পড়বে প্রতি কিলোওয়াট
৩০০০ ডলার। কিন্তু, রুপপুরের পরমাণু বিদ্যূতের জন্য কিন্তু বাংলাদেশ প্রতি কিলোওয়াটে
দাম দেবে ৫৫০০ ডলার। আমাদের যে সামর্থ্য বাড়ছে এবং আমরা যে বিশ্ববাজারে ক্রেতা হিসাবে
ভালো এর চেয়ে বড় প্রমাণ কি আর প্রয়োজন আছে?
কারো প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা বা বিদ্রুপ আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, আপনাদের মনে
থাকার কথা, ভালো সুরা না পেয়ে দেশীয় চোলাই সেবনে বাধ্য হওয়ায় একজন রুশ কর্মীকে গত এপ্রিলে
করুণ মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের কর্মীদের জন্য ভালো সুরার ব্যবস্থা কেন করা
হয় নি, সে প্রশ্ন কেউ করে নি। অথচ, ভালো বালিশের ব্যবস্থা করায় প্রকল্পের নির্বাহী
প্রকৌশলীকে তাঁর দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপরে যিনি
আছেন সেই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, কিম্বা তাঁরও ওপরে থাকা প্রধান প্রকৌশলী , তাঁর উর্ধ্বতন
প্রকল্প প্রধান – এঁদের কারও কোনো অনুমোদন ছাড়াই কি নির্বাহী সাহেব ক্রয়কর্মটি নির্বাহ করতে
পেরেছেন?
তদন্ত ছাড়া অবশ্য কারও ওপরই কোনো দায় চাপানো চলে না। বালিশ, তোশক, কেটলি, বৈদ্যূতিক
পাখাসহ যেসব দ্রব্য বেশিদামে কেনার অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর সবকিছুরই নিরীক্ষা ও তদন্ত
হওয়া উচিত বলে কথা উঠেছে। তদন্ত নাকি শুরুও হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তদন্ত শুধু অংশবিশেষের
কেন? কেন পুরো প্রকল্পের নিরীক্ষা নয় ?
ফেসবুকে কানাডাপ্রবাসী একজন লিখেছেন যে দামে রুপপুর প্রকল্পের আবাসন অংশ – গ্রীন সিটির বালিশ কেনা হয়েছে ওই দামে কানাডায় অর্ধডজন বালিশ পাওয়া যায়। কানাডা উচ্চআয়ের দেশ বলে সেখানে সব পণ্যই যে দামী হবে এমন কোনো কথা নেই। তিনি সম্ভবত: কমদামী অতিসাধারণ বালিশের বাজারমূল্যের কথা বলেছেন। অথবা, মৌসুমি বিশেষ ছাড় বা সেল থেকে যে দামে কেনা যায় তাও হতে পারে। কখনও কখনও আবার মেগাসেলও হয়ে থাকে যেখানে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় পাওয়া যায়।
অথচ, আমি যদি বলি একটি বালিশের দাম ৬৫ হাজার টাকাও হতে পারে তাহলে কি অবাক হবেন ? লন্ডনের হ্যারড্স নামে যে দোকান আছে সেটি ধনবানদের খুব প্রিয়। সেখানে ব্রিংকহউস নামের বালিশটির দাম ৬৪৯ পাউন্ড। ওই বালিশ আর্কটিক অঞ্চলের রুপালি হাঁসের পালক দিয়ে তৈরি। ওই একই উপাদানে তৈরি লেপের দাম ৩৭০০ পাউন্ড বা প্রায় চার লাখ টাকা। হ্যারডসের জিনিষপত্র রাজা-বাদশা কিম্বা ধনকুবেররা কেনেন বলে না হয় সেগুলোর কথা বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু, মধ্যম আয়ের স্বপ্নবিলাসীরা কি এরকম বালিশ কিনতে পারে না যা ঠান্ডার সময় আপনাআপনি গরম হবে, আর গরমের সময় ঠান্ডা। রেশমি নরম, অ্যালার্জিপ্রতিরোধক, ধূলা আটকায় না, তিলা পড়ে না এবং সবধরণের রাসায়নিক মুক্ত বালিশ। এসব গুণসম্পন্ন কোজিবু ব্যাম্বু মেমোরি ফোম পিলো নামের বালিশের দামটা খোঁজ করুন তো? অ্যামাজনে এই বালিশের দাম ব্রিটেনে ৫৯.৯৯ পাউন্ড। বাংলাদেশের টাকায় তাহলে রুপপুরের বালিশের দামের যে প্রায় সমান – সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না ?
এবার
একটু অন্য বিষয়ে নজর দিয়ে আসি। দেশে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের অভূতপূর্ব বিকাশের
কথা আমরা সবাই জানি। সামর্থ্য না থাকায় কিছু মানুষের হাতে মোবাইল ফোন না থাকলেও দেশে
১৬ কোটি মোবাইল ফোন আছে বলে বলা হয়। মানুষ এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে উবার, পাঠাও,
ওভাই, ওবোন এর গাড়ি, মোটরসাইকেল ডেকে সেবা কেনেন। একইভাবে, অনেকেই রাস্তার লম্বা যানজটের
বিরক্তি ও যন্ত্রণা এড়াতে অনলাইনে ছোটখাটো বাজার করে থাকেন। তো এরকম একটি অনলাইন বাজারে
একটা স্ক্রু ড্রাইভার কেনার জন্য দাম যাচাই করে দেখলাম, জিনিষটির দাম ২৫ টাকা। কিন্তু,
সেটি দেশের ভেতরে একটি ঠিকানায় পৌঁছাতে তারা ৩৯ টাকা চাইছেন। এখন একজন খেটে খাওয়া মিস্ত্রি
বা ইলেক্ট্রিশিয়ান হয়তো ২৫ টাকার জিনিসের জন্য ৩৯ টাকা পরিবহন খরচ দেবেন না। কিন্তু,
ক্রেতা যদি একজন স্বপ্নবিলাসী মধ্যম আয়ের কেউ হন? আমার মনে হয় তিনি খুব একটা পিছপা হবেন না।
চলুন
ফিরে যাই মধ্যম আয়ের পরমাণু বিদ্যূৎ প্রসঙ্গে। সংবাদপত্রের খবর বলছে, রুপপুর
প্রকল্পে যে বালিশের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা, তাতে মূল বালিশের দাম ৫
হাজার ৯৫৭ টাকা, আর আর সেই বালিশ ফ্ল্যাটে ওঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়েছে। পত্রিকাগুলো
ফ্লাটে বালিশ ওঠানোর খরচ লিখলেও সেগুলো পরিবহন কীভাবে হয়েছে, সেকথা বলেনি। সুতরাং,
ধারণা করা অমূলক হবে না যে অভিযুক্ত প্রকৌশলী কিম্বা ঠিকাদার বা তাঁরা উভয়েই অংক
করে হিসাবটি মিলিয়ে দেবেন। তাঁরা হয়তো বলবেন ২০ তলা ভবনের ১১০টি ফ্লাটের বালিশগুলো
আনতে কার্ভাড ভ্যান লেগেছে, তার সঙ্গে লেগেছে অন্তত দুজন শ্রমিক। ট্রাকের ভাড়া,
জ্বালানি, চালক ও শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদি মিলিয়ে যে খরচ হয়েছে, তা গড় করলে
বালিশপ্রতি খরচ একটুও বেশি নয়। মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গড় মজুরির হার কত এবং আমাদের
শ্রমিকরা সেই হারে পারিশ্রমিক পেয়েছেন কীনা সেসব প্রশ্ন অবশ্য কেউ করবে না। যদিও
সরকারী সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপ সূত্রে আমরা জানি দেশে প্রকৃত মজুরি
কমেছে। কিন্তু, তাতে কী? দেশটাতো মধ্যম আয়ের পথে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে!
বালিশ
কিম্বা আসবাবপত্র কেনায় দূর্নীতির খবর প্রকাশ করে গণমাধ্যম একটা দারুণ কাজ করেছে,
সন্দেহ নেই। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে এতেই কি গণমাধ্যমের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? বিপুল
অংকের দেনা বাড়িয়ে, অবিশ্বাস্যরকম ঝুঁকি নিয়ে আমরা যে পরমাণু বিদ্যূতের সাধ পূরণে
মনোনিবেশ করেছি সেবিষয়ে জাতীয় পরিসরে কতটুকু বিতর্ক হয়েছে ? গণতন্ত্রের দৈন্যদশায়
অদূর ভবিষ্যতে সেরকম বিতর্ক হবে এমনটিও কেউ আশা করেন না। সুতরাং, মধ্যবিত্তের মান
বাড়ানোর প্রকল্পের ছোটকর্তাদের দূর্নীতির বৃত্তের বাইরের বিতর্কে আমরা মনোনিবেশ
করতে পারবো কি ?
(৩ জুন, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত কলাম।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন