উন্নয়নের অর্থনীতিতে দেশে বৈষম্য বেড়েছে এবং এখনো বাড়ছে - এবিষয়ে কারোরই দ্বিমত
করার অবকাশ নেই। সরকারের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই দেশের অর্থনীতিবিদরা যেমন এই
বৈষম্য বাড়ার বিষয়টির কথা বলেছেন, ঠিক তেমনই আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও বিষয়টিকে
গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার তাগিদ দিয়েছেন। এরকম বাস্তবতায় হঠাৎ করেই বাজেট নাটকীয়ভাবে
দরিদ্রবান্ধব হবে অথবা ধনীদের ভোগ করতে থাকা রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলো কমবে বা বন্ধ হবে
এমনটি যাঁরা আশা করেছিলেন তাঁদের আশাবাদের তারিফ করতে হয়। কিন্তু, একইসঙ্গে এই রুঢ়
সত্যটাও বলা দরকার যে তাঁরা মোটেও বাস্তববাদী নন।
বাজেটের বিষয়ে গত দু-তিনদিনে বিভিন্ন ব্যাক্তি-দল-গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া দেখে
মনে হয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ বাজেটে ভিন্নতা
আশা করেছিলেন। হতে পারে, অর্থমন্ত্রী হিসাবে দশবছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটার কারণেই
হয়তো এমন ধারণা। যাঁরা আশাহত হয়েছেন তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলোর একটি উদ্ধৃত করলে আলোচনাটা
সহজ হবে : ‘‘সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটে ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের
অর্থনীতির সমৃদ্ধির পিছনে যাঁরা মূল শক্তি সেই কৃষক, শ্রমিক, নারী উদ্যোক্তারা বাজেটে
অবহেলিতই রয়েছেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলো লুটেরা ও খেলাপিদের হাতে বন্দী। সমৃদ্ধির পথ
চলায় বৈষম্যের যে সিন্দাবাদের দৈত্য জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে তার থেকে পরিত্রাণের কোনো
উপায় বাজেটে নেই। কেবল আয় বৈষম্যই নয়, আঞ্চলিক বৈষম্য , গ্রাম-শহরের বৈষম্য অর্থনীতির
ভারসাম্য নষ্ট করছে। দেশের সম্পদ এখন মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত।‘‘ মনে হতে পারে,
এই সমালোচনা বোধহয় বিরোধীদল বিএনপি কিম্বা কমিউনিস্ট পার্টির। কিন্তু, না। কথাগুলো
বলেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যে জোট ক্ষমতায় টানা দশ বছর র্পূণ করেছে, সেই জোটের
ছোট এক শরীক, দুই মেয়াদে মন্ত্রীত্ব করা ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন ( ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের বাজেট:
মেনন, প্রথম আলো, ১৫ জুন, ২০১৯)।
অনেকে বলতে পারেন, তৃতীয় দফায় মন্ত্রীত্ব না পাওয়ার বেদনা থেকে তিনি এমন সমালোচনা
করেছেন। আবার, কেউ এমন কথাও বলতে পারেন যে উনি বিরোধীদলের সারিতে ফেরার পথ খুঁজছেন।
কারণ যাই হোক না কেন, তাঁর যুক্তিগুলো নাকচ করা যাচ্ছে না। কৃষিতে সহায়তার জন্য বাজেটে
যেসব প্রণোদনার প্রস্তাব করেছেন সেগুলোতে প্রাথমিকভাবে লাভবান হবেন আমদানীকারক এবং
ব্যবসায়ীরা। অথচ, দাবি ছিল ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের
ন্যূনতম কিছু আর্থিক সহায়তার। সরকারী জরিপে দেশে প্রকৃত মজুরি কমার চিত্র উঠে আসার
কারণে সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা উপেক্ষিতই থেকেছে। বিপরীতে, অর্থনীতিবিদরা
যার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সেই পোশাক শিল্পের জন্য প্রণোদনা অব্যাহত থাকছে।
ব্যাংকগুলো যে লুটেরা ও খেলাপিদের হাতে বন্দী, সেই দশা থেকে সেগুলোকে মুক্ত করার কোনো
সুর্নিদিষ্ট পদক্ষেপ নেই। বরং, খেলাপির বোঝা বাড়তে থাকার বিড়ম্বনা এড়াতে এখন নতুন যুক্তি
হাজির করা হয়েছে যে চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে পরিমাণটা বড় দেখায়, আসল ঋণ খেলাপের পরিমাণ
অতটা নয়। ব্যাংকগুলো সুদ না পেলে তার পরিচালন ব্যয়ের সংস্থান কিভাবে হবে, সেই কথাটা
কি এতো সহজে ভুলিয়ে দেওয়া যায়?
ক্ষমতাসীন জোটের শরীক নেতা যে কথাগুলো বলেছেন , প্রায় সেই কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি
করেছে সুপরিচিত বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। তাদের কথায় এই
বাজেট ‘অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে‘। ক্ষমতাসীন জোটের নেতার ভাষায় ‘দেশের ব্যাংকগুলো যদি
লুটেরা এবং খেলাপিদের হাতে বন্দী‘ থেকে থাকে তাহলে সেই অবস্থাকে নিশ্চয় সুশাসন বলা যায় না? শাসনব্যবস্থার
দূর্বলতার সুবিধা না থাকলে এসব লুটেরা এবং খেলাপিরা নিশ্চয়ই অর্থনীতিকে এরকম ঝুঁকির
মুখে ঠেলে দিতে পারতেন না ? তবে, বলে রাখা ভালো, জোট শরীকের সমালোচনার জবাব না দিলেও
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে গুটিকয়েক মানুষ বাজেটের বিরুদ্ধাচরণ করছে। এমনকি, সিপিডি
আদৌ কোনো গবেষণা করে কিনা সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
বাজেটের সবচেয়ে বড় ব্যয় – প্রতি একশো টাকার ১৯ টাকাই খরচ হবে সরকারী কর্মকর্তা – কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়।
এর সঙ্গে পেনশনের ব্যয় যোগ করলে দাঁড়াবে ২৮ টাকা। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল দৈন্যতার শিকার হয়ে পড়লে সরকার যে শুধু প্রশাসনের
ওপরই নির্ভরশীল হবে, সেটা মোটামুটি সবারই জানা। অনুসঙ্গ হিসাবে কমছে প্রশাসনের জবাবদিহিতা।
নীতিনির্ধারণে রাজনীতিকদের চেয়ে আমলাদের দাপট বাড়ছে। তাঁদের আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাঁদের সরকারী সুযোগ-সুবিধা।
যদিও প্রতি বছরেই বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য প্রশাসনের অদক্ষতাকেই দায়ী করা হয়।
কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সহসাই এই ধারায় কোনো পরিবর্তনের কারণ নেই। সুতরাং,
যাঁরা বাজেট বাস্তবায়নে অদক্ষতা কিম্বা সামর্থ্যহীনতার সমস্যাকে বড় একটি সমস্যা দেখেন
তাঁদেরও উচিত হবে সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া। নামে গণতন্ত্র অথচ, কার্যকর বিরোধীদলহীন সংসদে জনবান্ধব বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের
অনুকূল বাজেটের প্রত্যাশা একেবারেই অর্থহীন।
শুধু প্রশাসনের কথাই বা বলি কেন ? সরকারের নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে যাঁরা আছেন
তাঁদেরই বা জবাবদিহিতা কোথায় ? নির্বাচন ব্যবস্থা যে দু:খজনক পরিণতি লাভ করেছে, সেখানে
শুধু দলের মনোনয়নই শেষ কথা। ভোটার তো দূরের কথা, দলীয় কর্মী-সমর্থকরাও এখানে গৌণ। ফলে,
স্বার্থের সংঘাত ( কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) এর ধারণা অনেক আগেই নির্বাসিত হয়েছে। আগের
মন্ত্রীসভায় বাস মালিক এবং পরিবহন শ্রমিকদের নেতারা মন্ত্রী থাকায় নানা বিতর্ক হলেও এই বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। ব্যাংক-বীমা-শেয়ারবাজার-পোশাক
শিল্পে যাঁর পারিবারিক স্বার্থ আছে, তাঁর কাছ থেকে ন্যয়পরায়ণ করনীতি কিম্বা সরকারী
পৃষ্ঠপোষকতায় ভারসাম্য প্রত্যাশা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আছে কিনা তা আমাদের
জানা নেই।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সব নীতি ও কৌশলের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বলা হয় যে
উন্নয়নই হচ্ছে এগুলোর মূল দর্শন। এবং এক্ষেত্রে জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হারকে বেশ
বড় করে দেখানো হয়। প্রবৃদ্ধির উচ্চহার এবং মাথাপ্রতি জাতীয় আয় বৃদ্ধির বিষয়টিকে দেশের
অগ্রগতির প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরার বিষয়টি বাংলাদেশের অনন্য কিছু নয়। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক
দশকে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে যে দুটি অর্থনীতি, তার একটি হচ্ছে চীন এবং অপরটি ভারত।
কিন্তু, বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ভারতে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর দেশটির গত দশকের জিডিপি
প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা
এখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম হারর্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রকাশনায় বলেছেন
যে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার আড়াই শতাংশ করে বেশি দেখানো হয়েছে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে এটি
৭ শতাংশ না হয়ে হবে সাড়ে চার শতাংশ। তিনি বলছেন সরকার যেভাবে হিসাব করেছে তা ভূল এবং
সেজন্যে তিনি নিরপেক্ষ প্যানেল গঠনের মাধ্যমে নতুন করে হিসাব-নিকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারীভাবে মি সুব্রামানিয়ামের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হলেও দেশটির পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে যে তারা
২০১৬ সালের কিছু তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছেন না। ৪৫ বছরের মধ্যে দেশটির বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি হওয়ার পরও সরকারী হিসাবের
৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন কীভাবে সম্ভব সেই প্রশ্ন এখন জোরালোভাবে উঠছে। ভারতের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদায়ী গর্ভণর রঘুরাম রঙ্গরাজনও তাঁর সংশয়ের কথা প্রকাশ করেছেন ( ইজ ইন্ডিয়া একজাজারেটিং ইটস ইকোনমিক
গ্রোথ, বিবিসি, ১৩ জুন, ২০১৯)। এর আগে
অবশ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক অ্যাডাম রবার্টস ভারতীয় অর্থনীতির কিছু দূর্বলতার
দিক তুলে ধরে সরকারের উচ্চৈস্বরের প্রচারণার বিষয়টিকে মোদির ‘স্ট্রংম্যান ইকোনমিকস‘ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন।
ভারতের মত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বলা
হচ্ছে এটি জবলেস গ্রোথ। বৈষম্য বৃদ্ধিতেও ভারতের সঙ্গে লক্ষ্যণীয় মিল রয়েছে
– দ্রুততম সময়ে ধনীরা
আরও ধনী হচ্ছেন। স্থানীয় বিনিয়োগও বাড়ছে না বলে অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। প্রবৃদ্ধির
হার নিয়েও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। বিষয়টিতে কেউ এখনও জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ
না করলেও ভবিষ্যতে যে করবে না তাও বলা যায় না। হঠাৎ করে যদি অর্থনীতির গুরুতর অসুস্থতা
ধরা পড়ে তাহলে তার রাজনৈতিক মূল্য অনেক বেশি হতে পারে। আমরা যারা অর্থনীতিবিদ নই, তাদের
কাছে তাই বাজেটের রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্নটিই বেশি করে নাড়া করে দেয়।
(১৭ জুন, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের কলাম। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন