গত ১৪ জুলাইর পর থেকে বেশ কয়েকজন বন্ধু আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ‘মৃত ব্যাক্তির সমালোচনা করতে নেই‘। তবে, তাঁরা কখনো মীর জাফর কিম্বা হিটলারের সমালোচনা
থেকে বিরত থেকেছেন, এমন নয়। বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসাবে তাঁরা মীর জাফর আলী
খানের নামকেই ব্যবহার করে এসেছেন। আর ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিটলারও যে জনগণের বিপুল
ভোটে নির্বাচিত ছিলেন সেই তথ্যও ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে কোনো দ্বিধা বা সংশয়ের
জন্ম দেয় নি। সাবেক সেনাশাসক ও বর্তমান সংসদের প্রয়াত বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন
মুহাম্মদ এরশাদের সৌভাগ্য যে রাজনৈতিক বিশ্বাস ভঙ্গ কিম্বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দীর্ঘ
ইতিহাস তিনি অনেককেই ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের সর্বসাম্প্রতিক ভোটার তালিকা অনুযায়ী দেশের মোট ১০ কোটি ভোটারের
মধ্যে ২২ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর
স্বৈরশাসক হিসাবে যাঁর পতন ঘটেছিল, তখনও ওই সোয়া দুই কোটি ভোটারের জন্ম হয়নি।
দেশের প্রথম সফল গণতান্ত্রিক গণজাগরণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাঁরা দিয়েছিলেন, সেই তিন
জোট – ১৫ দল, ৭ দল এবং ৫ দল যে একটি অভিন্ন
রুপরেখায় স্বাক্ষর করেছিল তার অঙ্গীকারগুলোর কথা এই বিপুলসংখ্যক তরুণের জানার কথা
নয়। অবশ্য, ইতিহাসের ছাত্র হলে ভিন্ন কথা। ইতিহাসে আগ্রহীরা জানেন যে মাত্র বছর
পাঁচ-ছয় না পেরোতেই জেনারেল এরশাদ প্রধান দুটি দলকেই তিনজোটের রুপরেখার কথা ভুলিয়ে
দিতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক সমীকরণে তাঁর সমর্থন পাওয়া এতোটাই গুরুত্বর্পূণ হয়ে ওঠে
যে জেনারেল এরশাদের অতীত তখন আর কোনো বিচার্য্য বিষয় থাকে নি। এই আপোষকারীদের
সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাঁরা শুধু আপোষেই ক্ষান্ত হননি, মিলেমিশে নতুন নতুন
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করেছেন। তবে,
লক্ষ্যণীয়ভাবে তাঁর মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকার এবং আওয়ামী লীগ একজন বিশ্বস্ত ও
নির্ভরশীল মিত্র খুঁজে পেয়েছিলো। ২০১৩ এবং ২০১৮‘র ক্রান্তিকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও সমর্থন বজায় রাখার
বিষয়টিকে অনেকে অবশ্য ১৯৮৬‘র প্রতিদান বলে অভিহিত করে থাকেন। রাজনীতি
থেকে নৈতিকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সুবিধাবাদিতার পথে পরিচালিত করার অসামান্য
কৃতিত্ব তাঁকে না দিয়ে কোনো উপায় নেই। আল-জাজিরার একজন বিশ্লেষক তাঁকে ‘সুবিধাবাদের গুরু‘ (মাস্টার অপারচুনিস্ট) অভিধায় অভিহিত
করেছেন, যা নাকচ করা সহজ নয়।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে দেশের সংবাদপত্রে জেনারেল এরশাদের জীবন ও কাজের যেসব
বিবরণ ছাপা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছে
বিদেশী গণমাধ্যমে। লন্ডনের টেলিগ্রাফ তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘কলঙ্ক-রোধক স্বৈরশাসক‘ (স্ক্যান্ডাল-প্রুফ
ডেসপট) হিসাবে স্মরণ করেছে। পত্রিকাটি নব্বুইয়ের আন্দোলনে তাঁর পতনের পর
বিরোধীদলগুলোর দেওয়া দূর্নীতির তালিকার কথা উল্লেখ করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে বিদেশী
দাতারা ত্রাণের জন্য যে সাহায্য দিয়েছে তার কোটি কোটি ডলার সুইস ব্যাংকে সরিয়ে
রাখার কথা। এখানে স্মরণ করা যায় যে বাংলাদেশ সরকার ৯১তে ফেয়ারফ্যাক্স নামের একটি ব্রিটিশ
বেসরকারী তদন্ত সংস্থাকে ওই পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য নিয়োগ করেছিল। তবে, রহস্যজনকভাবে
তা পরিত্যক্ত হয়।
টেলিগ্রাফের নতুন তথ্য হলো একজন মার্কিন তরুণীর সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের কথা।
টেলিগ্রাফের ভাষ্যমতে তাঁর ২৬ বছরের সন্তানহীন দাম্পত্যজীবনের পর যে বিস্ময় বালকের
জন্মের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, সে আসলে ওই মার্কিনী তরুণীর সন্তান এবং তাকে রাতের
অন্ধকারে গণভবনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। রাজনীতিকদের জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের
জানার অধিকার মোটামুটিভাবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। আশা করা যায় টেলিগ্রাফের এই অজানা
তথ্যের যর্থাথতা যাচাইয়ে দেশের গণমাধ্যম আর পিছিয়ে থাকবে না। প্রবাসী বাঙ্গালী
রমণী মরিয়াম মমতাজের সঙ্গে তাঁর বিয়ের যে কাহিনী তখন বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম
হয়েছিল সেকথাও টেলিগ্রাফ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তারা আরও লিখেছে তিনি তাঁর শাসনামলে
তাঁর সহকর্মীদের ১৮জনের স্ত্রীর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর, তাঁর তালাকপ্রাপ্ত
দ্বিতীয় স্ত্রীর বইতে তাঁরা রাজ্যহারা জীবনের প্রণয়কাহিনীগুলোও বহুলপ্রচারিত।
সম্মেলনগুলোতে তিনি হাজির হতেন দেরিতে, আর, কয়েক পংক্তি কবিতা লেখার অজুহাত
দিতেন। টেলিগ্রাফ লিখেছে তাঁর বিরুদ্ধে যত অপরাধের অভিযোগ ছিল তার মধ্যে কবিতা
চুরি অন্যতম। তিনি টাকা দিয়ে বাঙ্গালী কবিদের কবিতা কিনে নিজের নামে ছাপাতেন। আর্ন্তজাতিক
সম্মেলনগুলোতে তিনি হাজির হতেন দেরিতে, আর, কয়েক পংক্তি কবিতা লেখার অজুহাত দিতেন।
১৯৯১ সালের জুনে বেআইনী অস্ত্র রাখার মামলায় তাঁর ১০বছরের কারাদন্ড দন্ডিত
হওয়ার কথা উল্লেখ করে পত্রিকাটি লিখেছে তাঁর কারাজীবনকে মোটেও খারাপ বলা যাবে না।
তাঁর জন্য আলাদা প্রকোষ্ঠ এবং নিজস্ব বাবুর্চি
ছিল। তিনটি করে দৈনিক পত্রিকা পেতেন এবং ছিল একটি রেডিও । জেনারেল এরশাদ
তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর দল এখনও তাঁর ওই কারাবাসের জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা
জিয়াকে দায়ী করে থাকেন। ১৯৯৭ এ তিনি মুক্তি পেলেও অন্য এক দূনীতির মামলায় তিনি
আবার দন্ডিত হন। তবে, সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ – জেনারেল মঞ্জুর
হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়- যে মামলাকে রাজনৈতিক
দরকষাকষিতে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
পূর্বসুরি সামরিক শাসক, জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ
বাম-ডান-মধ্যপন্থী রাজনীতির সম্মিলন ঘটিয়ে তাঁর স্বৈরশাসনকে একটা গণতান্ত্রিক মোড়ক
পরানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, ১৯৮৬তে তাঁর রাজনৈতিক উদ্যোগে আওয়ামী লীগ এবং
জামায়াত সাড়া দিলেও বিএনপি এবং বামপন্থীরা তখন সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতা
হারানোর পর রাজনীতিতে পুর্নবাসনের প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের রসায়নটা
ক্রমশই কার্য্যকর হয়েছে এবং উভয়েই লাভবান হয়েছে। বিএনপি সাময়িকভাবে আপোষরফার
চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। দলগঠন ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সামরিক-বেসামরিক
গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো এবং ধর্মের ব্যবহারে এরশাদ তাঁর র্পূবসুরিকে ছাড়িয়ে
যান।
রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেওয়ার জন্য পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ‘ সংযোজনের জন্য
অনেকেই সাবেক সেনাশাসক জিয়াকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু, জেনারেল এরশাদ আরও একধাপ
এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার ৮ম সংশোধনী জারি করলেও রাজনৈতিক কারণে তাঁরাই আর
তাঁকে সাম্প্রদায়িক অভিহিত করেন নি। ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেশে প্রথমবারের মত
সংগঠিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। জেনারেল জিয়া
জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুর্নবাসিত করে নিন্দিত হয়েছেন। বিপরীতে,
রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের সামগ্রিক পুনরুত্থানে তাঁর উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদের
ভূমিকা বহুলাংশেই উপেক্ষিত থেকেছে। তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতাবিরোধী
মাওলানা মান্নান মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন জাময়াতুল মোদাররেসিন গড়ে তোলেন। এই
সংগঠনটি পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। আরও অন্তত অর্ধডজন পীর
তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতেও প্রভাবশালী হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও
আন্দোলনেও তাঁর সমর্থনের কথা সবারই জানা। তিনি মসজিদ-মাদ্রাসার বিদ্যূৎ ও পানির
বিল মওকুফ করে দিয়েছিলেন। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সখ্যতায় অবশ্য
মহাজোটের প্রগতিশীলরা কোনো সমস্যা দেখেন না।
যুদ্ধাপরাধের জন্য জামাত-বিএনপি ছাড়াও খোদ আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির
কয়েকজন নেতার মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড হয়েছে। কিন্তু, স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁর ভূমিকাও প্রয়োজনীয় যাচাইয়ের সম্মুক্ষীণ
হয় নি। তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক ট্রাইবুন্যালে কাজ করার অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব না
পাওয়াও কম বিস্ময়কর নয়। একইভাবে,
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অপরাধে তাঁর র্পূবসুরি বিপুলভাবে
নিন্দিত হলেও সেই খুনীদের রাজনীতিতে পুর্নবাসনের সূচনা ও সুযোগ করে দেওয়ার অপরাধ
উপেক্ষণীয়ই থেকে গেছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্ণেল ফারুক-রশিদরা ফ্রিডম
পার্টি তাঁর আমলেই গঠন করেন এবং ফারুক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন।
জেনারেল এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দল, জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বের উত্তরাধিকার
প্রশ্নে ইতোমেধ্যেই দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপাতত: তা শুধু পরিবারের
মধ্যেই সীমিত মনে হলেও তা আরও অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে বলে ধরে নেওয়া অন্যায়
হবে না। তাঁর সঞ্চিত সম্পদ নিয়েও একইধরণের রেষারেষি-সংঘাতের আশংকায় তিনি সেগুলোর
বিলি-বন্টন জীবদ্দশাতেই ঠিক করে গেছেন। কিন্তু, তাঁর সুবিধাবাদিতা ও নীতিহীনতার
উত্তরাধিকার রাজনীতির অঙ্গন থেকে সহসা দূর হবে না। সংবিধান, প্রশাসন ও
বিচারব্যবস্থার মত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ও স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদি
হয়ে ওঠার রাজনীতি যে ভোটের পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারে, তার দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
দক্ষিণ-র্পূব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে ভোটের রাজনীতিতে সফল দুতার্তের আদর্শ হচ্ছেন গণজাগরণে
উৎখাত হওয়া সামরিক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি খুব বেশি
দূরে আছি?
(২৫ জুলাই, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের কলাম।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন