সপ্তাহ খানেক আগে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ মারার খবরগুলো যখন
আর সহ্য করা যাচ্ছিলো না, তখন ক্ষমতাধরদের কেউ কেউ ডেঙ্গুর প্রকোপ বিষয়ক খবরগুলোকেও
গুজব অভিহিত করেছিলেন। যদিও সামাজিক মাধ্যম তখন ডেঙ্গু আক্রান্ত – বিশেষ করে
যন্ত্রণা-কাতর শিশুদের কান্নার ছবিতে সয়লাব। ফলে, গুজবের দোহাই সমস্যাকে আড়াল করার
চেষ্টা ছিল কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছিল। কিন্তু, মাত্র দিন দুয়েকের মধ্যেই কোনো এক রহস্যের
টানে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি আর দূর্ভোগ যে কতটা ব্যাপক, তা স্বীকার করে নিতে নিয়ন্ত্রিত
ভোটের মেয়রদ্বয় বাধ্য হয়েছেন। সারাক্ষণ তিনপ্রস্থ পোশাক পরিধানের কারণে এডিস মশা হয়তো
দক্ষিণের মেয়রের শরীরের নাগাল পায় নি। কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর কপাল মন্দ। এই মশার শুঁড়ে
কত যে জ্বালা তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
আমার আলোচ্য অবশ্য ডেঙ্গু নয়, সুতরাং ও প্রসঙ্গ থাক। ডেঙ্গুর কথা
উঠলো গুজবের সূত্র ধরে। গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির মহান দায়িত্ব নিয়ে একদল সাংবাদিক
৩ দিন ধরে ঢাকায় বিশেষ কার্য্যক্রম পরিচালনা করেছেন বলে সংবাদপত্রগুলোতে খবর ছাপা হয়েছে।
সংসদ প্রতিবেদকদের এই অভাবনীয় উদ্যোগের তারিফ না করে উপায় নেই। যে সংসদে সরকারের মনোনয়নে
কোনটি বিরোধীদল, তা ঠিক হয়, সেখানে তো আর সরকারের জবাবদিহিতার কিছু নেই। সুতরাং, লেখার
মত খবরও থাকে না। অতএব, জনসচেতনতা তৈরিতে মনোযোগী হওয়ায় বরং তাঁদের মেধা ও শ্রম কিছুটা
হলেও জাতির কল্যাণে ব্যয় হয়েছে, তা সে নিন্দুকেরা যাই বলুক না কেন। রাতের ভোটের সাংসদদের
সরকারের জবাবদিহিতা আদায়ের কোনো সুযোগ যেহেতু নেই, সেহেতু ঝাড়ু আর ফগার মেশিনের নাটকই
এখন খবর তৈরির মোক্ষম উপায়।
তবে, এতো কিছুর মধ্যেও জাতিসংঘ কমিটিতে নির্যাতন বিশেষজ্ঞদের কাছে
সরকারের জবাবদিহিতার বিষয়টি কিন্তু নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। অপরাধবিজ্ঞানে বহুলব্যবহৃত
বিশেষণ ‘ফরেনসিক একজামিনেশন‘
এর
প্রয়োগ যাকে বলে তাঁদের জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসাও যেন অনেকটা সেরকম। সংবিধান থেকে শুরু
করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বছরওয়ারি প্রতিবেদনগুলোর সব তথ্যই যেন তাঁদের নখদর্পণে
ছিল। আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে যা বিরল। ২০১৩ সালে ঢাকার মিরপুরে সংবাদপত্রকর্মী মাহবুব
কবিরের হাঁটুতে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে গুম, বন্দুকযুদ্ধ, রিমান্ড,
হেফাজত ও কারাগারে মৃত্যু, আইন-শৃংখলাবাহিনীর দায়মুক্তি ও বিচারহীনতা, বিচারবিভাগের
স্বাধীনতা, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা, নির্বাচনী সহিংসতা,
ভোটারদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মত বিষয়গুলোতে রীতিমতো প্রশ্নবানের মুখে পড়েন
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল। যেকোনো গণতন্ত্রে এধরণের প্রশ্নোত্তর, বিতর্ক কিম্বা আলোচনার
কেন্দ্রস্থল হওয়ার কথা পার্লামেন্ট। স্বাধীন বাংলাদেশে তেমনটি ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে
দুই দশক – ১৯৯১ থেকে
২০১২ সময়কালে, যার মধ্যে আবার বছর দুই কেটেছে জরুরি অবস্থার নিগড়ে।
তবে, মানতেই হয় যে আমাদের আইনমন্ত্রী - পেশাগত জীবনে ফৌজদারি আইনে
যাঁর দক্ষতা সুবিদিত - তিনি তাঁর ওকালতি কৌশল বেশ ভালোই প্রয়োগ করেছেন। বিকল্প সত্য
প্রতিষ্ঠা এবং কুৎসিত সত্য আড়ালের চেষ্টায় তিনি যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, তা অনেকটাই প্রেসিডেন্ট
ট্রাম্পের মত। সত্যের বদলে আবেগ ও বিশ্বাসকে
কাজে লাগিয়ে যুক্তি প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা ছিল, তা অলটারনেটিভ ট্রুথ কিম্বা পোস্ট-ট্রুথ
বাস্তবতার সঙ্গে তুলনীয়। খুব সহজ একটা উদাহরণ দেই। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদ ইউএনক্যাটে
বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে ১৯৯৮ সালে এবং সেই সনদের ১৯ ধারা অনুযায়ী একবছর পরই বাংলাদেশ নির্যাতন
বন্ধে কী করছে তার ওপর বিশেষজ্ঞ কমিটি ক্যাট ( কমিটি অ্যাগেনেস্ট টর্চার) এর কাছে একটা
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও সেটি না পেয়ে বাংলাদেশের
সরকারী প্রতিবেদন ছাড়াই ক্যাট এবছর এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে গতবছরের
শেষদিকে সরকারকে তা জানিয়ে দেয়। অবশেষে গত ২৩ জুলাই সরকার তার প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রথম
প্রতিবেদনটিতে ২১ বছর সময় কেন লাগলো ? এই প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বললেন ৭৫এ বঙ্গবন্ধু
হত্যার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয় এবং ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র ছিল না। অথচ,
প্রকৃত সত্য হচ্ছে ৯০এ একটি গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগসহ তিনজোটের য়ৌথ রুপরেখায়
দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১ সালের বহুলপ্রশংসিত নির্বাচনে তাঁর দল নির্বাচিত
না হওয়ায় সেটা গণতন্ত্র ছিল না, এরকম দাবিকে ‘বিকল্প
সত্য‘ প্রতিষ্ঠার
চেষ্টা ছাড়া আর কী বলা চলে? একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও যে সরকার দশ বছরে একটা প্রতিবেদন
দিতে পারেনা তার অযৌক্তিক কালক্ষেপণের যৌক্তিকীকরণের চেষ্টাকে কী বলা যায় ?
পরপর দু‘দিন
তিনঘন্টা করে দশজন বিশেষজ্ঞের কাছে অবলীলায় একটা বিকল্প জগত তুলে ধরতে পারা কোনো সহজ
কাজ নয়। এই যে গুম নিয়ে এতো আলোচনা, তার সহজ উত্তর, বাংলাদেশে গুম বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ত্ব
নেই এবং গুম বিষয়ক কোনো আইনও নেই। তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে একজন যখন বললেন, জাতিসংঘের
অন্য একটি কমিটি যে তিনজনের বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছিল তাঁদের সম্পর্কে জানান। ওই তিনজনের
একজন হলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের
চৌধুরী। যতটা রহস্যময় অবস্থায় হুম্মাম হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ফিরে আসাটা তার চেয়ে
কোনো অংশেই কম রহস্যময় ছিল না। আর, সেই রহস্যের চাদর আজও সরেনি। মন্ত্রী বললেন আত্মগোপন
এবং অপহরণের ঘটনাকে রাজনৈতিক কারণে গুম বলে অপপ্রচার করা হয়। তিনি সাবেক প্রতিমন্ত্রী
সালাউদ্দিনের ঢাকা থেকে রহস্যজনকভাবে ভারতে হাজির হওয়ার কথাও বললেন। কিন্তু, ওই বিশেষজ্ঞের
জিজ্ঞাসার অপর দুজন কিম্বা মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে ১০ বছরে ৫২৬ জনের গুমের কথা বলেছে,
সেগুলোর কোনো ব্যাখা মিললো না।
র্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃংখলাবাহিনীর
সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের সব অভিযোগই যে রাজনৈতিক তা নয়। অর্থাৎ, শুধুমাত্র রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, অভিযোগটা তার মধ্যেই সীমিত
নয়। এবারে বড় করে উঠে এসেছে ঘুষ বা অর্থ আদায় বা সম্পদ দখলের জন্য বেসামরিক নাগরিকদের
হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের প্রসঙ্গটি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মন্ত্রীর জামাইয়ের
মৃত্যুদন্ড হওয়ার তথ্য দিয়ে মন্ত্রী বললেন আইন-শৃংখলাবাহিনীর কাউকেই সরকার যে ছাড় দেয়
না , এই মামলা তার প্রমাণ। কিন্তু, নির্যাতনের প্রতি সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির যে
তথ্য মন্ত্রী কমিটিকে দিয়েছেন তার পিঠেই প্রশ্ন উঠেছে উখিয়ার কাউন্সিলর একরামুলের ক্রসফায়ারের
মোবাইল রেকর্ডিং কিম্বা সাতক্ষীরার মোখলেসুরকে থানায় স্ত্রীর ভাত খাইয়ে আসার পর তাঁকে
হেফাজতে নেওয়ার কথা অস্বীকারের মত ঘটনাগুলো কী স্বাক্ষ্য দেয়?এতো বেশি সংখ্যক নির্যাতন
ঘটনার অভিযোগ এবং সেগুলোর স্বাক্ষ্য-প্রমাণের বিশদ বিবরণ জিরো টলারেন্স প্রমাণ করে
না। বরং, আইন-শৃংখলাবাহিনীর অব্যাহত দায়মুক্তি ও বিচারহীনতার ইঙ্গিত দেয়।
দশজন সদস্যের ক্যাট জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী
সনদে অংশগ্রহণকারী সব দেশেরই পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশ যে বিশেষ
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ, বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু, বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিভ্ন্নি খুঁটি-নাটি
বিষয়েও কমিটি সদস্যদের প্রশ্ন করা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। এসব বিষয়ে সংসদে যেমন
আলোচনা বিতর্ক নেই, গণমাধ্যমের চিত্রও তেমনই হতাশাজনক। বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারি
আইন, কারা আইন কিম্বা পুলিশের বিধিমালার মত বিষয়গুলোতে যেখানেই অস্পষ্টতা বা সংশয়ের
অবকাশ আছে সেগুলোতে তাঁরা নজর দিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন কেন সেগুলোর সংস্কার হচ্ছে না,
বা হলে কবে হবে? পুলিশ ও র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত বা শৃংখলা ব্যবস্থা যে একেবারেই
অকার্যকর সেকথাও তাঁরা স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে, স্বাধীন নিরপেক্ষ নজরদারির
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর তাঁরা যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, আশা করি আমাদের
নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যম তাতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেবে।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে
মন্ত্রী বিচারকদের প্রশিক্ষণ, বিদেশ সফর এবং বেতনভাতা দ্বিগুণ করার কথা জানিয়ে আদালতের
মানোন্নয়নে সরকার কতটা তৎপর তা বোঝানোর চেষ্টা করলেও কমিটির নাছোড় বিশেষজ্ঞরা জানতে
চেয়েছেন বিচারক নিয়োগের আইন ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালতে
বিচারক নিয়োগের আইন না থাকার কথা।
দেশের ভেতরে এসব বিষয়ে খোলামেলা
বিতর্ক বা আলোচনা তেমন একটা হয় না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে– হয়রানি
এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয়। নির্যাতনের শিকার যাঁরা তাঁরাও চুপ থাকেন বিচারহীনতার
হতাশায়। আর, তৃতীয় দলটি নিশ্চুপ থাকেন দলীয় আনুগত্যের কারণে। এই বাস্তবতায় একটি আর্ন্তজাতিক
ফোরামের আলোচনায় যা উঠে এসেছে তার গুরুত্ব অনেক। নাগরিক গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিহিংসার শিকার
হতে হবে না মর্মে ক্যাটের অঙ্গীকার আদায় অবশ্য ইঙ্গিত দেয় এই ভীতিকর পরিবেশের কথা অন্যদের
অজানা নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন