সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আসামের রাষ্ট্রহীনরা মোটেও উপেক্ষণীয় নয়


জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর এর হিসাবে ২০১৮ সালের শেষে পুরো বিশ্বে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। আর, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে একদিনে রাষ্ট্রহীন ঘোষিত হয়েছেন তার ঠিক অর্ধেক, ১৯ লাখ, যারা প্রধানত: বাংলাভাষী মানুষ। এঁরা ১৯৭১ সালের আগে ভারতের বাসিন্দা ছিলেন এমনটি প্রমাণ করতে না পারায় অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন।
ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় এসব নাগরিকত্ব হারানো মানুষ হলেন ঘুণপোকা। চলতি বছরের নির্বাচনের সময়ে ওই আসামেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা ক্ষমতায় ফিরে এলে এসব অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে বিতাড়ণ করবেন। এই ১৯ লাখ অসমীয় বাংলাভাষীর নাগরিকত্ব হারানোর কারণ যে শুধু তাঁরা নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাতে পারছেন না, তা নয়। তাঁদের মুসলমান ধর্মপরিচয় হচ্ছে এর প্রধান কারণ। কেননা, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়পর্যায়ে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি সরকারের ঘোষিত নীতি হচ্ছে তাঁরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ধর্মবিশ্বাসী অভিবাসীদের নাগরিকত্ব নিয়মিতকরণ বা বৈধ করে নেবেন। তালিকা প্রকাশের পরপরই বিজেপির অভিযোগ কৌশলে অনেক মুসলমানের ভারতীয় হিসাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ তাঁদের প্রত্যাশা ছিল ৪০ লাখের নাগিরিকত্ব হরণ হবে।
জাতিগত নিপীড়ণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন জাতিগত নিপীড়ণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সেটাই প্রত্যাশিত। উপরন্তু, বাংলাদেশ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধবিষয়ক সনদ, রোম স্ট্যাটিউটে স্বাক্ষরকারী দেশ। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে : ১. প্রত্যেকেরই নাগরিকত্বের অধিকার রয়েছে, এবং ২. কাউকেই ইচ্ছা হলেই নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং তাঁর নাগরিকত্ব বদলানোর অধিকারও অস্বীকার করা যাবে না। আর, রোম স্ট্যাটিউটে জনগোষ্ঠীর জোরপূর্বক বহিষ্কার কিম্বা স্থানান্তর, আর্ন্তজাতিক আইনের মৌলিক বিধিমালা লংঘন করে তাদের দৈহিক স্বাধীনতা গুরুতররুপে খর্ব করা অথবা বন্দী রাখাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।  
বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতার নিরীখে বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি স্পর্শকাতর, সন্দেহ নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের সময়ে অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছেন বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকায় আসার পর আবারও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের একক বৃহত্তম নাগরিকত্ব হরণের ঘটনা কি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উপেক্ষা করা চলে?
যাঁদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে তাঁদেরকে ভারত বাংলাদেশি বলেই অভিহিত করছে। তাদেরকে হয়তো এখনই বহিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে না। কিন্তু, পর্যায়ক্রমে ওই প্রক্রিয়া শুরু হতে যে খুব বিলম্ব হবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এঁদেরকে যে বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পুর্নবাসনের পরিকল্পনা হচ্ছে তাও নয়। কেননা, পশ্চিমবঙ্গেও কথিত অবৈধ বাংলাদেশি চিহ্নিত করণে এনআরসি চালুর কথা বলেছে বিজেপি। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি তাদেরকে বহিষ্কারের জন্য নেপাল, পাকিস্তান বা চীনের সীমান্তে নিয়ে যাবে? নাকি, বাংলাদেশি অভিহিত করার কারণে এসব বাংলাভাষীকে তাঁদের সবচেয়ে কাছের সীমান্তে জড়ো করে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হবে? তাছাড়া, অবৈধ চিহ্নিত হওয়ার পর আটক হওয়া এবং বন্দী জীবনযাপনের আশংকায় তাঁদের অনেকেই যে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করবেন না, তার নিশ্চয়তা কি?     
ইউএনএইচসিআরের যে পরিসংখ্যানে বিশ্বে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা ৩৮ লাখ বলা হয়েছে, সেই হিসাবেই বাংলাদেশ গতকাল (শুক্রবার) পর্যন্ত ছিল সর্বাধিকসংখ্যক রাষ্ট্রহীন নাগরিকের আশ্রয়দাতা দেশ। শনিবার থেকে ভারত হচ্ছে সর্বাধিক রাষ্ট্রহীন বাসিন্দার অধ্যূষিত দেশ। যে দশ লক্ষাধিক ( ইউএইচসিআরের হিসাবে ৯ লাখ ৬ হাজার ৬৩২ জন) রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আমরা বর্তমানে আশ্রয় দিচ্ছি তাঁরা সবাই রাষ্ট্রহীন। মিয়ানমার তাঁদের নাগরিকত্ব হরণ করে নেওয়ার কারণেই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া স্বদেশে ফিরতে রাজি হচ্ছেন না।
স্মরণ করা প্রয়োজন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ৮০র দশকে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে। নাগরিকত্ব হরণের কারণ হিসাবে মিয়ানমারের দাবি আরাকানে বসতিস্থাপনকারী এসব নাগরিক বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। আর, অঘোষিত কারণ হচ্ছে তাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান। তাদের ভাষা আরাকানী হলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাভাষী বলেই অভিহিত করে থাকে। নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার পর থেকে প্রথমে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বর্তমানে বেসামরিক সরকার , উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠী ও কিছু বেসামরিক গোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যূত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। যে কারণে, আশির দশক থেকে শুরু করে প্রতি দশকেই একাধিকবার করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে যে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
আসামের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। কথিত অহমীয় জাতীয়তাবাদের ধূয়ো তুলে আশির দশকে অসম ছাত্র গণ পরিষদ নামে নতুন এক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন সহিংসতার চরম রুপ নেয়। প্রায় দুই হাজার বাংলাভাষী মুসলমানকে হত্যা করা হয়, যেটি গুজরাটের আগে ছিল ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বৃহত্তম গণহত্যা। বোড়ো জঙ্গি গোষ্ঠীরও আক্রমণের লক্ষ্য জন এসব বাংলাভাষী মুসলমান। কংগ্রেস সেসময়ে সেই রক্তক্ষয়ী সহিংস আন্দোলন মোকাবেলায় ১৯৮৫ সালে অসম ছাত্র গণপরিষদের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করে, যাতে সেখানকার নাগরিকত্ব যাচাই এবং রেজিস্ট্রার (এনআরসি) চালুর অঙ্গীকার করা হয়। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এখন ৩৪ বছর পর রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে এখন যেকেনোভাবে সেই এনআরসি বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে।
অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে আসামের সংখ্যালঘু মুসলমান আরো বেশি পশ্চাৎপদ হওয়ায় তারা যেমন পিছিয়ে আছে শিক্ষায়, তেমনই আর্থিক সামর্থ্যে। ফলে, যাদের জন্মের রেজিষ্ট্রেশন করা নেই, তাদের পক্ষে নাগরিকত্ব প্রমাণের আইনী লড়াই চালানো প্রায় অসম্ভব। অথচ, অনিশ্চয়তার আতংক তাঁদের ওপর চেপে বসেছে। এ অবস্থায় তাঁদের জোরপূর্বক বা স্বেচ্ছায় বাংলাদেশমুখী করা বা হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং, এত বড় একটি মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কার মুখে একে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় অভিহিত করে নির্লিপ্ত থাকার মানে দাঁড়াবে মিয়ানমারের মতই আরেকটি করুণ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করা। এখনেও আমাদের সীমান্ত ছোঁয়নি বলে নিকটভবিষ্যতে না হলেও দূরভবিষ্যতে তা হবে না এমন ভাবনা আত্মঘাতি।
(১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এর প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...