বাংলাদেশে কারাগারগুলোর দূর্দশার কথা নতুন কিছু নয়। সিলেট এবং চট্টগ্রামের
দুজন পদস্থ কারা কর্মকর্তার সাম্প্রতিক গ্রেফতারের পর প্রকাশিত তাঁদের সম্পদবিবরণীতে
অবশ্য ধারণা হতে পারে কারাগারগুলো নিশ্চয়ই ধন-সম্পদের খনি। নাহলে, সেখানে কোটি কোটি
টাকা উপার্জন কিভাবে সম্ভব? দেশে গণতন্ত্রের যে দৈন্যদশা তাতে অন্যসব বিষয়ের মতোই সংসদে
অথবা মাঠে-ময়দানের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিতর্কে কারাগারগুলোর আসল চিত্র জানার কোনো সুযোগ
হয় না। দেশে যেহেতু বিরোধীদল বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ত্ব নেই, সেহেতু এসব বিষয়ে কেউ কোনো
প্রশ্নও করে না। সুতরাং, নিশিকালের ভোটে গঠিত সরকারের জবাবদিহিতারও কিছু নেই। তবে,
গতমাসে জেনেভায় জাতিসংঘ কমিটিতে দশজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের জেরার মুখে প্রকাশ পাওয়া
কিছু সরকারী তথ্যে আঁতকে উঠতে হয়।
আমাদের কারাগারগুলোতে যত বন্দী আছেন তার ৮১ শতাংশ বিচারাধীন। অর্থাৎ,
তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলেও তাঁরা দন্ডিত আসামী নন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে
তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা কারাগারের দেওয়ালের
বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা অন্য সবার মতই নিরপরাধ। আমাদের বিচারব্যবস্থার দূর্বলতা
এবং পুলিশ ও তদন্ত সংস্থার অদক্ষতা ও দূর্নীতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া যেহেতু দীর্ঘায়িত
হয়, সেহেতু কথা উঠতে পারে, ভয়ংকর অপরাধের আসামীদের কারাগারে আটক রাখাই শ্রেয় এবং যৌক্তিক।
কিন্তু, সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যটি এসেছে এ প্রসঙ্গেই। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী
কমিটি ক্যাটকে জানিয়েছেন যে সরকারী নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে মামলায় অভিযুক্তদের
দন্ডিত হওয়ার হার হচ্ছে প্রতি একশো মামলায় মাত্র তিনটি।
আইনমন্ত্রী অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের
প্রথম দেশ, যেখানে বিচারবিভাগের নিরীক্ষা (জুডিশিয়াল অডিট) পরিচালনা করা হচ্ছে এবং
সেই নিরীক্ষাতেই দেখা গেছে ফৌজদারি মামলায় সাফল্যের হার ৩ শতাংশ। একেকটি মামলায় একাধিক
আসামীও থাকে। ফলে, প্রতি একশোজন অভিযুক্তের মধ্যে দন্ডিত হওয়ার হার হবে আরও কম। কমিটি অবশ্য বিচারাধীন আসামী এবং দন্ডিত অপরাধীদের
যে একসঙ্গে রাখার কথা নয় তা উল্লেখ করে কারাগার এবং হাজতখানাগুলোর দুর্দশার কথা স্মরণ
করিয়ে দিয়েছে। তাদের হিসাবে, এসব বন্দীশালায় ধারণক্ষমতার চেয়ে গড়ে ২১৫ শতাংশ বেশি।
বন্দীদের ঘুমাতে হয় পালা করে। খাবারের মান খারাপ, এমনকি খাবার পানিও পর্যাপ্ত পরিমাণে
পাওয়া যায় না। পয়োব্যবস্থা অস্বাস্থ্যকর।নারীদের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ
প্রায় অনুপস্থিত।দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাত্র ১২ টিতে আছে হাসপাতাল। ১৭০জন কারা
চিকিৎসক পদের মধ্যে মাত্র ডজনখানেক বাদে সব পদই শূণ্য। হাজতখানাগুলোর অবস্থা কারাগারগুলোর
থেকে উন্নত এমনটি ভাবতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু, রাজনৈতিক বন্দী ও সংবাদকর্মীদের অভিজ্ঞতাগুলো
তা বলে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোর সময়ে ‘গণগ্রেপ্তার‘ নামে যেসব নির্বিচার ধরপাকড় চলে তখন হাজতখানায় কেউ
ঝিমুনোরও সুযোগ পান কিনা সন্দেহ।
নির্যাতনবিরোধী কমিটির পর্যালোচনায় কারাগার এবং হেফাজতখানাগুলোর অবস্থা
এতোটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু, হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর অভিযোগের যেসব
ভয়াবহ পরিসংখ্যান ও বিবরণ পাওয়া যায় তাতে হরে-দরে আটক হওয়া ব্যাক্তিদের দূর্ভোগের
বিষয়টি গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। হেফাজতে নির্যাতনের প্রধান
কারণ সাধারণভাবে দুটো - প্রথমত: জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় এবং দ্বিতীয়ত: আইন-শৃংখলাবাহিনীর
সদস্যদের কিছু কিছু সদস্যের ঘুষ নেওয়া বা অবৈধপন্থায় উপরি আয়ের ব্যবস্থা। অনেকের
জন্য বিস্ময়কর হলেও ক্যাটের আলোচনায় দ্বিতীয়টি এবার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
সিলেটের একজন পুলিশ কনস্টেবলের কাছ থেকে হেফাজতে নির্যাতনের কৌশলগুলো জেনেছিল আমাদের
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আর, তাদের প্রতিবেদন থেকেই আমরা জেনেছি হেফাজত বা রিমান্ডে
প্রয়োগ করা কৌশলগুলোর কথা। সা-রে-গা-মা থেরাপি, ব্যাট থেরাপি বা বাদুড় ধোলাই, স্নেক
থেরাপি, ওয়াটার থেরাপি, পেনিস থেরাপি, ডান্সিং টর্চার নামে নির্যাতনের যেসব পদ্ধতি
প্রয়োগ করা হয় সেগুলো থেকে রক্ষা পেতে জায়গা-জমি বন্ধক দিয়ে হলেও ঘুষের টাকা যোগানো
তখন ভুক্তভোগীদের স্বজনদের জন্য ফরজ হয়ে পড়ে। তবে, রাজনৈতিক মামলা কিম্বা স্পর্শকাতর
মামলাগুলোতে বারবার রিমান্ড মঞ্জুরের যে চল শুরু হয়েছে তাতে পুলিশের ভাষ্যমত স্বীকারোক্তি
না দিয়ে পার পাওয়া খুবই বিরল।
প্রশ্ন হচ্ছে মাত্র তিন শতাংশ দন্ডাদেশের জন্য পুলিশ ও আইন-শৃংখলাবাহিনীর
ভাবমূর্তি যখন নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
তখন সেই নীতিকৌশল বদলানোর প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা চলে? এতো স্বল্প হারে অভিযোগ
প্রমাণের কারণ কি তদন্তকারীদের অদক্ষতা ? নাকি, ঘুষ-দূর্নীতির অভিযোগটাই সত্যি ? এ
দুটোর কোনোটিই আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের
পর্যবেক্ষণে তা গুরুত্ব পেয়েছে।
ক্যাট তার পর্যালোচনার উপসংহারে এসব অভিযোগ যে স্বাধীনভাবে তদন্তের
সুপারিশ করেছে তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাই অযথা বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। র্যাব, পুলিশ
এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিদ্যমান ব্যবস্থা কতটা অকার্যকর ও হাস্যকর, তা নিয়েও নতুন করে আলোচনার
কিছু নেই। ‘নিজের অপরাধ নিজে বিচার করা‘র যুগ অনেক
আগেই পেরিয়ে গেছে। এসব বাহিনীপ্রধানরা এর আগে বহুবার বলেছেন যে কোনো বাহিনীর সদস্যের
বিরুদ্ধে অভিযোগের দায় ওই বাহিনীর নয়, ব্যাক্তির । সেই বক্তব্যের আলোকেই বলা প্রয়োজন,
স্বাধীন স্বতন্ত্র তদন্তের দাবিটিও কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, অভিযুক্ত সদস্য ও কর্মকর্তাদের
বিরুদ্ধে।
এখানে
স্মরণ করা প্রয়োজন, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধে আইন তৈরির দাবি স্বাধীনতার পর
সব সরকারই নানা অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ২০১৩ সালের যে হেফাজতে নির্যাতন ও
মৃত্যু নিবারণ আইনের কৃতিত্ব সরকার দাবি করেন, সেটিও হেফাজতে নির্যাতিত একজন সাংসদের
(সাবের হোসেন চৌধুরী) উত্থাপিত বেসরকারী বিলের সফল রুপায়ণ। হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে
ক্যাট যে সুপারিশগুলো করেছে সেগুলোর মধ্যে আছে, আইন-শৃংখলাবাহিনী হিসাবে যারা তালিকাভুক্ত
রয়েছে তার বাইরেও রাষ্ট্রের অন্য যে কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিধানটি কার্যকর করা;
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিশ্চিত করা; হেফাজতে নেওয়া স্বীকারোক্তিকে
আইনগতভাবে গ্রহণ না করা এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বদলে অপরাধ তদন্তে বৈজ্ঞানিক
বা ফরেনসিকস অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেওয়া। এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফরেনসিক
অনুসন্ধানে (যেমন অপরাধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও ঘটনাস্থলে আঙ্গুলের ছাপ কিম্বা ডিএনএর মিল,
সিসিটিভির ফুটেজ, অন্যান্য আলামতের সঙ্গে অভিযুক্তের যোগসূত্র) পাওয়া প্রমাণগুলো তুলে
ধরে অপরাধীকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে উদ্বুদ্ধ করা।
হাজতখানা এবং কারাগারগুলোর
স্বাধীন পরিদর্শন ব্যবস্থার বিষয়টিও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ। এরকম নিবারণমূলক
ব্যবস্থা চালু থাকলে অন্তত: ফেনীর কারাগারে স্থানীয় সাংসদের সহযোগীদের তাঁর রাজনৈতিক
প্রতিদ্বন্দীকে কারাভ্যন্তরে ঢুকে ভীতিপ্রদর্শনের অভিযোগ শুনতে হতো না। সর্বোপরি, ক্যাটের
পর্যবেক্ষণে নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তি ও তাদের পরিবার পরবর্তীকালে হুমকি, হয়রানি ও
প্রতিশোধের ভয়ে বিচার চাইতেও সাহস করে না বলে যে অভিমত এসেছে তা দূর করতে স্বাধীন ও
স্বতন্ত্র নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।
ক্যাটের
পর্যবেক্ষণে নির্যাতন সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে ৭৫টিরও বেশি সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো নিয়ে
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই তাদের ইতিবাচক মতামত বা সম্মতি জানিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের
জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ভবিষ্যতে সেগুলো নিয়ে আরও বিতর্ক-আলোচনা হবে।
তবে, প্রকৃত দোষীর সঙ্গে অভিযুক্তের অবিশ্বাস্য অনুপাতের কারণেই কারাগার এবং হেফাজতের
আলোচনা জরুরি। কেননা, এতো বিপুল সংখ্যায় নিরপরাধ মানুষ হেফাজতি হিসাবে বছরের পর বছর
অবর্ণনীয় দূর্ভোগের শিকার হবেন, এবং কেউ কেউ অপরাধীদের সংসর্গে পড়ে অন্ধকারের পথ অনুসরণে
প্রলুব্ধ হবেন – এই অসুস্থ প্রক্রিয়া আর চলতে
দেওয়া উচিত নয়। এই অসুস্থতা সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটায়, তা প্রতিকার করে না।
(১৯ অগাস্ট, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন