বাংলাদেশে গুমের কোনো প্রচলন নেই। বছরকয়েক ধরে মন্ত্রীরা দেশে এবং
দেশের বাইরে এমনটিই দাবি করে আসছেন। সুতরাং, গতমাসে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে
(ক্যাট) আইনমন্ত্রীর মুখে একই কথার পুনরুচ্চারণ অপ্রত্যাশিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র এবং
যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশগুলোতে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের পরিসংখ্যান দিয়ে এমনও বলা হয়েছে
যে, ওইসব দেশে হাজার হাজার নিখোঁজ লোকজনের ব্যাপারে গণমাধ্যমে কোনো হই চই হয় না। আইনমন্ত্রী
বলেছেন, অনেকেই নানাকারণে অপহৃত হন, আত্মগোপন করেন এবং পরে ফিরে আসেন। আবার, অনেকেই
রাজনৈতিক কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যে এসব আত্মগোপন বা অপহরণকে গুম
বলে প্রচার করেন।
সরকার যেহেতু গুম বলে কোনোকিছু আমাদের বাংলাদেশে ঘটে বলে স্বীকারই
করে না সেকারণে ধরে নেওয়া যায় ‘গুম হওয়া
থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদ’ স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেনি। আমাদের রাজনৈতিক
দলগুলো এবং নাগরিক সমাজ থেকেও কখনো এই সনদ স্বাক্ষরের জন্য সরকারের ওপর জোরালো চাপ
সৃষ্টি বা দাবি জানানো হয়নি।
তবে, সরকার যেসব সনদে সই করেছে সেগুলোও যে মেনে চলার কোনো চেষ্টা
আছে, ব্যাপারটা তা নয়। যেমন রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সনদের (আইসিসিপিআর)
কথাই যদি ধরি, তাহলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে বছরের
পর বছর বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া সম্ভব ছিল না।
গুমের কথায় ফিরে আসি। গুম এবং হারিয়ে যাওয়া বা নিখোঁজ হওয়ার ফারাকটা
বোঝার জন্য গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদে গুমকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত
করা হয়েছে সেটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। সনদের ধারা ২ বলছে : রাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি
কিম্বা রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতায়িত, সমর্থিত বা
রাষ্ট্রের মৌনসম্মতিতে কাউকে গ্রেফতার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনোভাবে তার স্বাধীনতা
বঞ্চিত করা হয় এবং নিখোঁজ ব্যাক্তিকে স্বাধীনতাবঞ্চিত করার বিষয়টি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি
জানানো, তাঁর অবস্থান গোপন রাখা, যাতে তিনি আইনের সুরক্ষার বাইরে থাকেন, তা গুম হিসাবে
বিবেচিত হবে। স্পষ্টতই, কোনো অপরাধীচক্রের দ্বারা অপহৃত অথবা পাওনাদারকে ফাঁকি দিতে
কিম্বা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করা কেউ ওই সংজ্ঞার আওতায় পড়েন না। আর, পরিবারের কারো
সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষের বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো পরিবার সরকার
বা রাষ্ট্রকে দুষবে না।
২৬ অগাস্ট এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এএইচআরসি বাংলাদেশে ২০০৯
থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে গুম হওয়া মানুষের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।
তাদের তালিকায় মোট ৫৩২ জনের নাম আছে। এঁদের প্রত্যেককে কবে, কোত্থেকে, কারা কী পরিচয়ে,
কীভাবে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তার বিবরণ আছে। এঁদের প্রত্যেকের ভাগ্যে কী ঘটেছে তাও রয়েছে
তালিকায়। এঁদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী অথবা প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ বা ভাষ্যগুলোতে
যাঁরা তুলে নিয়ে গেছে বলে বলা হয়েছে, তাঁরা আইন-শৃংখলাবাহিনীর পরিচয় দিয়েই তা করেছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু,
পরে স্থানীয় থানা এবং অন্যান্য আইন-শৃংখলাবাহিনীগুলোর ( র্যাব, গোয়েন্দা বিভাগ ইত্যাদি)
দপ্তরে ভুক্তভোগীর পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবরা ধর্ণা দিয়েও তাঁদের প্রিয়জনের আর কোনো
খবর পান নি।ওই তালিকায় দেখা যায় ২০০৯ সালে গুম হয়েছিলেন ৩জন, যাঁদের মধ্যে একজন ৪৪
দিন আটক থাকার পর মারা মারা যান এবং দুজনের এখনও কোনো সন্ধান মেলেনি। যে দুজনের খোঁজ
মেলেনি তাঁদের একজন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের খিলগাঁ শাখার নেতা
মাহমুদুল হক রনি।এরকম বছরের পর বছর নিখোঁজের সংখ্যা অনেক। দূর্ভাগ্যের শিকার অনেক পরিবার
হঠাৎ করেই হয়তো জেনেছে তাঁর প্রিয়জনের লাশ কোথাও পড়ে আছে। যাঁরা অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান,
তাঁদেরকে কয়েক দিন,সপ্তাহ,মাস পর অন্য কোনো জায়গা থেকে অন্য কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার
দেখানো হয়েছে।
যাঁরা নানা কারণে বহুল আলোচিত হাতে গোনা কয়েকজন আবিষ্কৃত হয়েছেন
অন্য কোনো জনপদে অসুস্থ অবস্থায়। অবধারিত রুপে অর্ন্তধানের সময়টুকুর কথা তাঁদের মনে
নেই, সেসম্পর্কে তাঁরা কিছুই বলতে পারেন না। ভবিষ্যতে কোনোদিন তাঁদের স্মৃতিশক্তি ফিরে
আসুক, আমরা সেই প্রার্থনাই করি। তাঁরা যে গুম হন নি, সরকারকে বিব্রত করতে আত্মগোপনে
গিয়েছিলেন, এমন স্মৃতি মনে পড়লে আমরা সবাই স্বস্তি পাবো। আমাদের মন্ত্রীরা এবং আইন-শৃংখলাবাহিনীর
চৌকষ কর্মকর্তারা গর্বের সঙ্গে সবাইকে বিশ্বাস করাতে পারবেন যে তাঁরা কোনো অন্যায়ের
সঙ্গে জড়িত নন।
বাংলাদেশ গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করলে নির্যাতনবিরোধী কমিটির মতোই
গুম বিষয়ক কমিটির কাছে নিয়মিত বিরতিতে রিপোর্ট পেশ এবং তা নিয়ে নানারকম প্রশ্নের মুখে
পড়তে হতো। কিন্তু স্বাক্ষরকারী না হওয়ায় যে রেহাই মিলছে, তাও নয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার
পরিষদের গঠন করা অন্য আরেকটি কমিটি আছে, যা ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অ্যান্ড ইনভলান্টিারি
ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস ( ডাব্লুজিইআইডি) নামে পরিচিত। ওই কমিটি ভুক্তভোগীদের পরিবারের
আবেদন এবং বেসরকারী সংগঠন বা এনজিওদের তথ্যের ভিত্তিতে গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করে।
তারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে গুম ব্যাক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানার চেষ্টা করে থাকে।
জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সর্বসাম্প্রতিক নথিতে (জুলাই মাসে
তৈরি) দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬১ জনের গুম রহস্যের এখনও কোনো কিনারা হয়নি। এরমধ্যে, কমিটি
সরকারের কাছে পাঁচজনের গুমের বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে তথ্য জানতে চেয়েছে। গুমের ঘটনা উদ্বেগজনক
হারে বাড়ার কারণে এই কমিটি ২০১১ সালের ৪ মে, ২০১৬ সালে ৯ র্মাচ, ২০১৭‘র ২২ ফেব্রুয়ারি এবং গত ২৯ জুন উদ্বেগ
প্রকাশ করে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে। কমিটি ২০১৩ সালের ১২ই মার্চ আলাদা চিঠি দিয়ে
বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানানোর অনুরোধও জানিয়েছে। ওই অনুরোধের বিষয়ে তারা আরও পাঁচবার
সরকারকে চিঠি লিখলেও সরকার তাঁদের অনুরোধে সাড়া দেয় নি।
শুরু করেছিলাম ক্যাটে বাংলাদেশের বক্তব্যের প্রসঙ্গ দিয়ে। ক্যাট
যে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে তাতে নির্যাতনের অন্যান্য অভিযোগের মতোই গুম বিষয়ে
সরকারের ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। তাঁরা কমিটির সভায় যে কয়টি ঘটনার বিষয়ে নির্দিষ্ট
করে প্রশ্ন করেছেন সেগুলোর অধিকাংশেরই জবাব পান নি। কমিটির কথায় ‘রাষ্ট্রের
কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতা নির্বিচারে হরণ, পরে তাঁদের অনেককে হত্যা
এবং তাঁদের অবস্থান বা ভাগ্যে কী ঘটেছে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার যে অসংখ্য,
সঙ্গত খবর পাওয়া যায়, তা নিয়ে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন‘। কমিটি গুম
বা আনঅ্যাকনলেজড ডিটেনশন, অর্থাৎ অঘোষিত বা অস্বীকৃত আটক বিশেষণ ব্যবহার করে এসব অভিযোগ
তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বিষয়টিতে সাতটি সুপারিশ করেছে। তদন্তের বিষয়ে কমিটি বলছে অস্বীকৃত
আটক, গুম এবং হেফাজতে মৃত্যুর সব অভিযোগ দ্রুত ও বিস্তারিত তদন্তে এমন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত
করতে হবে, যা আটকের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে।
কমিটির সামগ্রিক পর্যবেক্ষণের একটা বড় অংশই হচ্ছে আইন-শৃংখলাবাহিনীর
নির্বিচারে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগের ব্যপকতা। তাদের উদ্বেগের সবচেয়ে
গুরুতর অংশ হচ্ছে, নির্যাতন ও গুমের শিকার ব্যাক্তির পরিবারের অভিযোগ গ্রহণে পুলিশের
অস্বীকৃতি এবং অভিযোগকারীদের পরবর্তীতে হুমকি, হয়রানি ও প্রতিশোধের শিকার হওয়া।
বাংলাদেশ চলতি বছর থেকে তিন বছর মেয়াদে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের
সদস্যপদে আঞ্চলিক কোটায় বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছে। সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে
নিজেদের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করার বিষয়টি তাই নৈতিক দিক থেকেই আবশ্যক। সরকার
যদি এতোই আত্মবিশ্বাসী হয় যে দেশে গুম বলে কিছু ঘটে না এবং অভিযোগগুলো মূলত অপপ্রচার,
তাহলে অচিরেই তিনটি কাজ তার করা দরকার। এগুলো হলো: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত,
গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর এবং গুমবিষয়ক কমিটিকে সফরের আমন্ত্রণ জানানো।
(৩০ অগাস্ট, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন