প্রতিবেশী দেশ, মিয়ানমারের
জাতিগত নির্মূল নীতির কারণে পরিচালিত গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা প্রায়
১০ লাখ রোহিঙ্গাকে সার্মথ্য না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। এই মাহাত্ম্যের
কারণেই মানবিক জাতি হিসাবে গত দু‘বছর আমরা
বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত হয়েছি। কিন্তু, গত কয়েকদিনের কিছু পদক্ষেপের কারণে তা হারানোর
উপক্রম হতে চলেছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। চলতি সপ্তাহে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়
সংবাদপত্রগুলোতে বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গটি আবারও ফিরে এসেছে। তবে, তা মোটেও
সুখকর নয়।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মোবাইল ফোন সেবা বন্ধের নির্দেশই এসব শিরোনামের
প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরে
সরকারকে সমর্থন না দিলে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা হবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
হুঁশিয়ারি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি জার্মান রেডিও ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে
এই হুঁশিয়ারি দেন। তাছাড়া, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করে এমন কয়েকটি বেসরকারী উন্নয়ন
সংস্থা বা এনজিওর কার্য্যক্রম বন্ধ করা , সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গাবিরোধী কিছু সমাবেশ
এবং মাদকের কারবার ও মানবপাচারের মত অপরাধে কয়েকজনের জড়িত থাকার অভিযোগের কারণে সবাইকে
দায়ী করার প্রবণতার বিষয়গুলো এসব সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। অপরাধে জড়িত সন্দেহে সন্দেহভাজন
কয়েকজন রোহিঙ্গার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার প্রসঙ্গও বৈশ্বিক গণমাধ্যমের চোখ এড়ায়নি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে মোবাইল সেবা বন্ধের ব্যাখ্যায় সরকার
বলেছে এই পদক্ষেপ অপরাধী চক্রগুলোর তৎপরতা কমাবে। কিন্তু, একই বাক্যে সংবাদদাতা জন
ইমন্ট লিখেছেন, অধিকারকর্মীরা বলছেন যে বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠী আরও বিছিন্ন হয়ে পড়বে। নিজ
মাতৃভূমি মিয়ানমার থেকে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং খবর রাখার জন্য উদ্বাস্তু
জনগোষ্ঠী মোবাইল সেবার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং এই সিদ্ধান্ত তার ওপর একটি বড় আঘাত। কঠোর
বিধিনিষেধের মধ্যে থাকা রোহিঙ্গারা এতে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে (বাংলাদেশ কাটস মোবাইল
অ্যাক্সেস টু রোহিঙ্গা রিফিউজিস, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
নিউইয়র্ক টাইমস একইধরণের ভাষ্যের পাশাপাশি লিখেছে মিয়ানমারের নেতৃত্ব
যেখানে এখনও সহিংসতার দায় স্বীকার এবং ভবিষতে আর কোনো সহিংসতা হবে না এমন অঙ্গীকার
করে নি, সেখানে বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠাতে চাইছে। পত্রিকাটির
সংবাদদাতা হানা বিচ লিখেছেন, বাংলাদেশ মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয়
দিলেও উদ্বাস্তু হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কেননা ওই স্বীকৃতির সঙ্গে
অনেকগুলো অধিকার দেওয়ার প্রশ্ন আসে ( এ মিলিয়ন রিফিউজিস মে সুন লুজ দেয়ার লাইন টু আউটসাইড
ওর্য়াল্ড, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। রাতেরবেলা এবং ভোরে শিবিরগুলোতে মোবাইল সংযোগ থাকে
না উল্লেখ করে পত্রিকাটি লিখেছে রাতের বেলায় সেখানে কার্ফ্যু থাকায় বিপদ ঘটলেও সাহায্যকর্মীরা
সেখানে যেতে পারেন না। অন্যান্য জায়গার মতোই এত বড় একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সময়ে সময়ে
সহিংসতা এবং নানাধরণের
অপরাধ ঘটতেই পারে। মাদক কারবারসহ অপরাধ দমনকে মোবাইল নিষিদ্ধের কারণ হিসাবে সরকারীভাবে
বলা হলেও রোহিঙ্গারা বলছেন নিরপারাধ লোকজনকেও অহেতুক শায়েস্তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে
উদ্বাস্তু শিবিরের মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রসঙ্গে পত্রিকাটি শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া,
সুদান এবং ভারতের কথা উল্লেখ করে বলেছে ওইসব দেশে সংঘাতকে আড়াল করার জন্যই ইন্টারনেট
বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে কোনো সংঘাত নেই এবং তা আড়াল করার প্রশ্নও নেই। কিন্তু
এরকম একটা তুলনা চলে এসেছে।
গার্ডিয়ান লিখেছে, জল্পনা রয়েছে যে
সামরিক অভিযানের মুখে মিয়ানমার থেকে নির্বাসিত হওয়ার দুইবছর পূর্তিতে গত ২৫ অগাস্ট
অহিংস সমাবেশ আয়োজনের কারণেই যোগাযোগব্যবস্থায় এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ওই সমাবেশের
অনুমতি প্রদানকারী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণের কথা জানিয়ে সংবাদদাতা ক্যারেন
ম্যাকভে লিখেছেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে
বাংলাদেশ সরকারের হতাশা বাড়ছে ( বাংলাদেশ ইমপোজেস মোবাইল ফোন ব্ল্যাকআউট ইন রোহিঙ্গা
রিফিউজি ক্যাম্পস, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। এই নিষেধাজ্ঞা কার্য্যকর করা কঠিন হবে বলে
জাতিসংঘের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, মোবাইল সিম এর একটা কালোবাজার রয়েছে এবং সেখানে অল্প টাকাতেই তা পাওয়া
যায়। দ্বিতীয়ত: অনেকের কাছে মিয়ানমারের সিম আছে যেগুলো পাহাড়ের ওপরে উঠলে সচল হয়। স্থানীয় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যাকান্ডের জেরে গত
সপ্তাহান্তে চর্তূথ আরেকজন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তর গুলিতে নিহত হওয়ার কথা তাদের প্রতিবেদনে
উঠে এসেছে।
ইকোনমিস্ট সাময়িকীও অনাকাঙ্খিত অতিথিদের
নিয়ে বাংলাদেশের হতাশার কথা লিখে বলেছে তাদেরকে আরও বিচ্ছিন্ন করায় কোনো সমাধান নেই
( নো সিগনাল: বাংলাদেশ ব্যানস মোবাইল ফোনস ফর ওয়ান মিলিয়ন রোহিঙ্গা রিফিউজিস)। ধারণক্ষমতার
অতিরিক্ত সংখ্যক উদ্বাস্তু তাঁদের নির্ধারিত শিবির এলাকার বাইরে যেতে পারেন না বলে
বাকি বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন। ইকোনমিস্ট জাতিসংঘের
একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করেছে, যিনি বলেছেন, এর মাধ্যমে নির্যাতিত একটি জনগোষ্ঠীকে
আরও বিচ্ছিন্ন এবং দূর্ভাগের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর আশংকা এর মাধ্যমে তাঁদেরকে
নেতিবাচক কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে, তা সে অপরাধ হোক কিম্বা জঙ্গীবাদ।
প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কূটনৈতিক
ব্যর্থতায় সরকারের মধ্যে হতাশা বাড়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেকারণে নীতিনির্ধারকদের
মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিলে বাকি বিশ্বের কাছে তা গোপন থাকার কথা নয়। মোবাইল ফোনের ওপর
নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে অস্থিরতার এখানেই ইতি ঘটেনি,
তার বহিপ্রকাশ দৃশ্যমান হচ্ছে এনজিওদের প্রতি সরকারের আচরণসহ আরও কিছু ঘটনায়। এনজিওগুলো
এবং আর্ন্তজাতিক ত্রাণকর্মীরা শুধুই যে উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজ করছে, তা নয়। স্থানীয়
জনগোষ্ঠীর ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবেলায় তাদেরকেও সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সন্দেহ নেই, প্রয়োজনের তুলনায় তা কম। কিন্তু, কৃষিকাজে সহায়তার জন্য সংগৃহীত নিড়ানি-কোদাল-দা
উদ্ধার করে তাকে অস্ত্র উদ্ধার হিসাবে প্রচারের মত হাস্যকর প্রয়াসে বিস্মিত হতে হয়।
জাতিসংঘ সংস্থা, আইওএম এর বিবৃতির পর পুলিশের কর্তাব্যাক্তিরা এই অভিযানের কী ব্যাখ্যা
দেবেন?
কথিত অস্ত্র উদ্ধার, রোহিঙ্গাদের
সংগঠিত করা এবং ফিরে যেতে বাধা দেওয়ার যেসব অভিযোগ এনজিওদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে তা
দেশের বাইরেও ত্রাণকর্মীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অথচ, এধরণের বিপুল সংখ্যক বিপন্ন
মানুষের জরুরি সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রাতারাতি সরকারী আমলারা অর্জন করতে
পারবেন না। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এবং এসব এনজিওর কারণেই দুটি বর্ষা মৌসুমে বড়ধরণের
কোনো দূর্ঘটনা ও মহামারি এড়ানো গেছে।
সরকারের এই অস্থিরতার সংক্রমণ
ঘটেছে প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক এবং কিছু কিছু গণমাধ্যমের ওপর। ফলে, দায়িত্বহীন
বিদ্বেষমূলক প্রচার বেড়েই চলেছে। ২৫ অগাস্টের রোহিঙ্গা সমাবেশ নিয়ে আতংক ছাড়ানোর চেষ্টা
চলেছে। অথচ, সেই সমাবেশে কেউই বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসন বা নাগরিকত্ব দাবি করেনি। তারা
বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তাদের দাবি ছিল : গণহত্যার বিচার, মিয়ানমারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং
নিরাপদে নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন। যেসব রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মাদকের
কারবার এবং মানবপাচারের মত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, তাঁরা যে সেগুলো স্থানীয়
কারো সহযোগিতা ছাড়া করতে পারেন না, সেটা কি অস্বীকার করা চলে? কক্সবাজারের মাদকসম্রাট
হিসাবে যাঁদের নাম সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় বছরের পর বছর উঠে এসেছে, তাঁদের
পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এধরণের অপরাধের বিস্তার ঘটছে, এমনটি ভাবা কঠিন। সুতরাং, আগে প্রয়োজন
চিহ্নিত দেশীয় অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর
হওয়া। চারজন রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছে ক্রসফায়ারে উল্লেখ করে হিউম্যান
রাইটস ওয়াচ ইতোমধ্যেই এগুলো তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
উদ্বাস্তুদের হেয় করে, ভয় দেখিয়ে কিম্বা জোর করে
ফেরত পাঠানোর চিন্তা অর্থহীন। চীন বা ভারতের মধ্যস্থতা বা বুদ্ধিতে ভরসা রেখে দুই বছরেও কোনো ফল হয়নি।
এখন আরও সময় নষ্ট করা আত্মঘাতি। আর্ন্তজাতিক সংকটের সমাধান দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে হবে
না সেটা বুঝতেই পার হয়েছে দুই বছর। এখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় সমাধানের বিভ্রান্তির
শিকার হলে তা হবে দূর্ভাগ্যজনক। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি বজায় থাকা অবস্থাতেই তাকে
কাজে লাগানোর সর্বোত্তম চেষ্টা প্রয়োজন। রোহিঙ্গারাও ফিরতে চায়, আমরাও চাই তারা ফিরে
যাক। কিন্তু, সেজন্যে প্রয়োজন তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা
আদায়। সুতরাং, মনোযোগটা সেখানেই দেওয়া প্রয়োজন। নাহলে মানবিকতার জন্য নন্দিত বাংলাদেশের
নিন্দিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
(৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন