স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বের শিখরে
পৌঁছেছে- উভয় দেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক এবং নীতিনির্ধারকরা গত প্রায়
এক দশক ধরে অব্যাহতভাবে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে এই কথাটিই বলে চলেছেন। সন্দেহ নেই
এই দাবিটি ভারতের দিক থেকে খুবই যৌক্তিক। বাংলাভাষী সব মুসলমানকে অবৈধ বাংলাদেশীর তকমা
লাগিয়ে সীমান্তের এপারে ঠেলে দেওয়া যদি লক্ষ্য না হয়, তাহলে ভারতের বাংলাদেশ-নীতিতে
এমন কোনো লক্ষ্য সম্ভবত আর নেই যা অর্জিত হয় নি। বাংলাদেশের ভারত-নীতিতে কী কী অর্জিত
হয়েছে বা হয়নি সেবিষয়ে আলোচনা আমার আজকের উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ, বৈরিরাষ্ট্রের চেয়ে বন্ধুরাষ্ট্রের
সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে নীতি অনুসরণ করে চলেছে সেটুকুতেই
মনোননিবেশ করাই এখন বেশি জরুরি।
৭ বছর আগে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের
শিরোনাম ধার করে এই পত্রিকাতেই লিখেছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতি সীমান্ত । ভারতের
সঙ্গে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রসঙ্গে সেদিন যেসব কথা লিখেছিলাম তার যে কোনো পরিবর্তন
ঘটেনি তার স্বীকারোক্তি স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়ের কথায় সুস্পষ্ট।৮ ফেব্রুয়ারি
ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক এক সভায় অংশ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন সীমান্ত হত্যা আগের চেয়ে বেড়েছে।এটা বন্ধ করতে সরকার
তৎপর রয়েছে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য সীমান্তহত্যা আগের চেয়ে বেড়েছে, প্রথম আলো,
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)। এর এক সপ্তাহ আগে ২ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন
বলেছেন এবছর সীমান্ত হত্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা খুবই দু:খজনক ঘটনা। তিনি জানান ভারতীয়
হাইকমিশনারকে ডেকে এনে তিনি বলেছেন‘ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেক উন্নত।এর মধ্যে এগুলো
হবে কেন? এটা খুবই লজ্জাজনক (এ বছর সীমান্ত হত্যা অনেক বেড়ে গেছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী,
প্রথম আলো অনলাইন, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০) ।
উভয় মন্ত্রীর কথাতেই বোঝা যায় সীমান্ত হত্যা কখনোই বন্ধ হয় নি এবং
আগের চেয়ে এখন তা অনেক বেশি বেড়েছে। অথচ, এর আগে উভয় সরকারের তরফ থেকে একাধিকবার বলা
হয়েছে যে সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে।কয়েকবছর আগে এমন ঘোষণাও দেওয়া
হয়েছিল যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করবে না। স্পষ্টতই, সেরকম
কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে তা শুধু কাগজে-কলমেই নথিবদ্ধ হয়ে আছে, কার্যকর হয়নি।
তবে, গত ২৫ জানুয়ারি নিজের নির্বাচনী এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে একদিনেই
তিনজনের মৃত্যু ঘটলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বন্ধুরাষ্ট্রের কোনো দোষ দেখেন
নি। তিনি বলেছিলেন ‘আসলে আমাদের চরিত্র ভালো না হলে পরের
দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই’। তিনি আরও বলেছিলেন ‘ভারতে অনুপ্রবেশ
করে কেউ গরু আনতে গিয়ে গুলিতে নিহত হলে সরকার তার দায় নেবে না’। খাদ্যমন্ত্রী
কোনোধরণের তদন্ত ও স্বাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই যেভাবে নিজের দেশের নাগরিকদের অপরাধী
গণ্য করলেন তার কোনো ব্যাখ্যা সরকারের তরফে পাওয়া যায় নি। তিনিও তাঁর মন্তব্যের জন্য
দু:খপ্রকাশ করেন নি। তাঁর এরকম মন্তব্য শুধু নিষ্ঠুর ও অমানবিক নয় বরং যে কোনো নাগরিকের
জন্য অবমাননাকর। কেউ যদি খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকেই বাংলাদেশের সরকারী নীতি বলে
বিবেচনা করেন তাহলে তা মোটেও অযৌক্তিক হবে না। তাঁর স্বপদে বহাল থাকায় এমন প্রশ্ন উঠতেই
পারে।
সীমান্ত দিয়ে যে শুধু গরুই পাচার হয় বিষয়টি এমন নয়। নানাধরণের মাদক,
সোনার মত নানাধরণের বিলাসসামগ্রী, প্রধানত নারী ও শিশুসহ মানবপাচার - এগুলোর সবই সীমান্ত
ব্যবস্থাপনার সমস্যা। সাম্প্রতিক বছরগুলোর সরকারী-বেসরকারী হিসাব এবং অনুমান দুটোতেই
গরু পাচার কমেছে বলেই তথ্য মেলে। বাংলাদেশের ভেতরে গরুর খামারগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ
চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে বেশ কয়েকবছর আগেই। কিন্তু, ফেনসিডিল বা ইয়াবার
মত মাদকে বাংলাদেশ স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন করেছে এমন কোনো তথ্য কোথাও মেলেনি। ওগুলোর
সরবরাহ এখনও বাইরে থেকেই আসে।মানবপাচারও বাংলাদেশমুখী নয় , বরং তা বিপরীতমূখী। মাদক
এবং মানবপাচারের মত অপরাধই যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবিদার সেকথা
অবশ্য তেমন একটা জোর দিয়ে কেউ বলেন না।
সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধ শুধু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেই ঘটে বিষয়টি
এমন নয়। বরং, এই সীমান্তটি এমনই বিচিত্র ও জটিল যে তা বহু পরিবারকে দুভাগে ভাগ করে
ফেলেছে, চাষের জমি একদিকে, আর ভিটেমাটি অন্যদিকে এমন বিভাজনও আছে। এরকম বাস্তবতায় বেড়া
পেরোনো মানেই গরু আনতে যাওয়া ব্যাপারটি সবসময়ে এমন নয়। ভারতের সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রের
অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৈরি সম্পর্ক যে দেশটির, সেটি হচ্ছে
পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের ঝুঁকিকেই ভারত তার নিরাপত্তার
ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে দাবি করে থাকে। অথচ, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে আর্ন্তজাতিকভাবে
স্বীকৃত সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক নিহতের সংখ্যা শূণ্যের ঘরে।দুই দেশের মধ্যে যে সীমান্তে
সমস্যা ঘটে সেটি হচ্ছে বিরোধর্পূণ কাশ্মীরের বিভাজন রেখায় এবং সেসব সংঘাত মূলত সামরিক
প্রকৃতির। হতাহতদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা।
মাওবাদী বিদ্রোহীপীড়িত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ভারতের সীমান্তের আরেকটি
উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নেপালের সঙ্গে। সেখানেও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা বিরল।
মিয়ানমার বা ভুটানের সীমান্তেও এধরণের বেসামরিক নাগরিক হত্যার কথা শোনা যায় না। তাহলে
বাংলাদেশ সীমান্তে এই নিষ্ঠুরতা কেন?
মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বরে
‘ট্রিগার হ্যাপি’ শিরোনামে
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ
করেছিল। বছরওয়ারি নিহত বাংলাদেশির নাম এবং ঘটনাস্থলের বিবরণ তুলে ধরে তারা দেখিয়েছিল
এই শতকের প্রথম ১০ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন এক
হাজারের মতো বাংলাদেশি। যার মানে হচ্ছে ওই দশকে প্রতিবছর গড়ে ১০০ জন অর্থাৎ প্রতি
সাড়ে তিন দিনে একজন করে বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতবছরের জুলাইতে
সংসদে জানিয়েছিলেন যে ২০০৯ থেকে ২০১৯ এই দশ বছরে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২৯৪ জন বাংলাদেশী।
বেসরকারী হিসাবে তা এর কয়েক গুণ।শুধু মাত্র গতবছরেই আইন সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে সীমান্তে
নিহত হয়েছেন ৪৬ জন।
বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের তৎপরতার কারণে ভারতের যেসব নিরাপত্তা
উদ্বেগ ছিল সেগুলো নিরসনে বাংলাদেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা সেদেশে বহুলভাবে প্রশংসিত
হয়েছে। নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর হওয়ার পর সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় যেধরণের পরিবর্তন আশা করা
হয়েছিল তা ঘটেনি।বোধগম্য কারণেই তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিকে লজ্জাজনক বলে অভিহিত
করেছেন। কিন্তু, লজ্জা তো সীমান্তবাসী নিরীহ নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেবে না। নাগরিকদের
নিরাপত্তাকে সবার ওপরে স্থান দিতে হলে সরকারের কিছুটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে দ্রুততায় আমরা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে
এগিয়ে যাচ্ছি সেগুলোর পুর্নমূল্যায়নের কথা এখন ভাবা উচিত। রেল কিম্বা নৌপথে নতুন কোনো
সংযোগ বাস্তবায়নের আগে নিজেদের নাগরিকদের প্রাণহানি শূণ্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার পূরণের
দাবি জানানোর এখনই সময়। বর্তমান সরকার তার বারো বছরের শাসনে সাধ্যমতো ভারতের অনুরোধ
রক্ষা করেছে। পানির হিস্যাসহ অনেককিছুর ক্ষেত্রেই ন্যয্য প্রতিদান মেলেনি। সেগুলো নিয়ে
দেন-দরবার চলতেই পারে। তবে, নিরীহ নাগরিকদের জীবনরক্ষার প্রশ্নে কোনো ছাড় চলে না।
(১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন